কোভিড-১৯ যুদ্ধক্ষেত্রের এক সৈনিকের বক্তব্য : ডাঃ অনির্বাণ জানা, শল্য চিকিৎসক

0

HnExpress ২৪শে জুলাই, সুদীপ ঘোষ, নদীয়া ঃ প্রথম সারির করোনা যোদ্ধার এক বাস্তব ইতিকথা শোনালেন ডাক্তার অনির্বাণ জানা। এ যেন “টু বি অর নট টু বি” র ঠিক উল্টোদিক। পজিটিভ আর নেগেটিভের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অপরিসীম আতঙ্কে ভোগা। কোনদিকে যাওয়া কপালে লেখা আছে কে জানে! কি বললেন ডাক্তার অনির্বাণ জানা? শুনে নিন তাঁরই জবানীতে —

এ যেন আগুনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আগুন নেভানো, যা নেভাতে গেলে তোমাকেও পুড়তে হতে পারে। মৃত্যুও অসম্ভব নয়। যেসব ডাক্তাররা প্রাইভেট সেক্টরে রয়েছেন বা যাঁরা নিজেরা প্র্যাকটিস করেন তাঁদের যন্ত্রণাটা সরকারি হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তারদের থেকে কিছুটা আলাদা। তাদের কথা পরেই বলা যাবে। আর একজন সার্জন বলে আমাদের সরাসরি জ্বরের রোগীদের মুখোমুখি হতে হয় না। কিন্তু হঠাৎ করেই আবার বড়ো বিপদের মুখোমুখি হতে হয় সার্জনদের। কয়েকদিন আগেই এমনই একটা অ্যাক্সিডেন্টের রোগী এসেছিল।

গা থেকে মদের উৎকট গন্ধ। দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছে না। সে নাকি এই অবস্থায় বাইক নিয়ে বেরিয়ে ছিল বন্ধুবান্ধবরা কেমন আছে জানতে। রাস্তা আর পাঁচিলকে চাঁদের মায়াবী আলোয় একই রকম লেগেছিল তাঁর। ফলে সে রাস্তা ভেবে বাইক নিয়ে পাঁচিলে ধাক্কা মেরেছে। শরীরের এতো জায়গায় সেলাই দিতে হলো যে ফুলিয়া, শান্তিপুর হলে একটা বড়ো শাড়ি তৈরি হয়ে যেতো। তবে সেলাই করতে করতে বুঝতে পারছিলাম লোকটির গায়ে বেশ জ্বর আছে। শ্বাসেরও কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু করোনার ভয়ে যদি সেলাই করা ছেড়ে দিই তাহলে তো বেচারি রক্তপাত হয়েই মারা যাবে।

ছেলেটা কথা বলার মতো অবস্থায় ছিল না। সেলাই করা শেষ হতে অপারেশন থিয়েটারের বাইরে দাঁড়ানো ওর বন্ধুবান্ধবদের ধরি। একজন বললো যে ছেলেটা নাকি কোনোদিনই মদ ছোঁয়নি। আরেক জন বললো যে মদ খায়, তবে সে অল্পস্বল্প। একজন বললো যে ছেলেটি কোনোদিন বাইরে যাইনি। ওদের মধ্যে একটি ভালোমানুষ ধরনের ছেলে মোক্ষম কথাটা আমায় জানিয়ে দেয় সেদিন। কদিন হ’ল মুম্বাই থেকে বাড়ি এসেছে ছেলেটি। সত্যি কথা বললে তো সবাই সাবধান হতে পারি।

এই সাধারণ বোধটা আজও অনেকের নেই। রোগটা তাহলে আর ছড়াতে পারে না। বুকের ভেতর একটা ভয় হামাগুড়ি দেয়। কারণ পরিণতিটা আমরা জানি। হাসপাতালে রাখা এক সেট পোশাক ভালো করে হাত পা ধুয়ে পরে নিই। বাড়িতে ফিরে সেই পোশাকটাও ছেড়ে স্নান করি। কিন্তু হিসাব অনুযায়ী খুব বিপজ্জনক ভাবে আমি রোগীর সংস্পর্শে এসেছি। যাঁরা এমারজেন্সি অপারেশনের সাথে যুক্ত, তাঁরা প্রত্যেকে একমত হবেন যে আমরা সরু সুতোর ওপর দিয়ে হাঁটছি। ক্লান্তিজনিত অবসাদ এলেও ভয় হয়, জ্বর আসছে নাতো?

ডাক্তারদের মধ্যে অনেকেই এ সময়ে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু ঠিক সেই সময়ে সাধারণ মানুষের কিছু কিছু মন্তব্য মনোবল ভেঙে দেয়। এবার একজন স্ত্রীলোক বিশেষজ্ঞর গল্প শোনাই। ভালো মানুষ হিসেবে চিকিৎসক মহলে পরিচিত। অনেক গরীব মানুষের চিকিৎসা তিনি বিনা পারিশ্রমিকে করে দিয়েছেন। হাসপাতালেও সবার বিপদে আপদে পাশে দাঁড়ান। একদিন সন্ধ্যার দিকে তাঁর জ্বর এলো। কয়েকদিন বেশ পরিশ্রম গেছে, অনিয়মও হয়েছে। জ্বর তো আসতেই পারে। তবু পরদিন থেকে চেম্বার ও হাসপাতালে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন।

যতটা পারেন ফোনে ফোনে অপারেশন হয়ে যাওয়া রোগীদের অ্যাডভাইস দিচ্ছিলেন। কিন্তু রোগীরা মোটেই খুশি নয়। একজন তো পরিষ্কার বলেই দিলো যে ডাক্তারবাবু করোনা হবার ভয়ে রোগী দেখছেন না। যা রোজগার করার তাতো করেই নিয়েছেন, এবার রোগীর স্বার্থ দেখার আগে নিজের স্বার্থ দেখছেন। ডাক্তারবাবু ঠিক সময়ে নিজের পরীক্ষা করালেন এবং রিপোর্ট নেগেটিভ এলো। খুব ভালো কথা। অসুস্থ শরীরে তিনি পেশেন্ট দেখতে নেমে এলেন।

হাসপাতালের ডাকেও স্বাস্থকর্তাদের সাথে কিছু জরুরি আলোচনা চালাতে হলো। অভিজ্ঞ ডাক্তার, লক্ষণগুলো দেখে মনে হলো, রিপোর্টটা ফলস নেগেটিভ হয়নি তো? এরকম সম্ভাবনা খুব অল্প হলেও আছে। আবারও টেস্ট করালেন, সবার আপত্তি সত্বেও। এবার এলো পজিটিভ। কোয়ারান্টাইনে যেতে হলো তাঁকে। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে “ছি ছি”র বন্যা। এতো অর্থপিশাচ ডাক্তার হয়? শুধু টাকা রোজকারের জন্য করোনা আক্রান্ত হয়েছেন জেনেও চেম্বারে বসেছিল? সেই বক্তাদের ভিড়ে একজনকে চেনা গেলো, তাঁর স্ত্রীকে ডাক্তারবাবুই বাঁচিয়েছিলেন।

হাতুড়ে চিকিৎসক তার স্ত্রীর গর্ভপাত করাতে গিয়ে নাড়ি ফুটো করে ফেলেছিল। অনেক কষ্টে তাকে বাঁচিয়ে ছিলেন সেবার। হাসপাতালের কারো আশা ছিল না যে রোগী বাঁচবে। ফোনে সেকথা ডাক্তারবাবুকে জানাতেই সহাস্য জবাব, “বিদ্যাসাগর ঠিকই বলে গিয়েছেন।” যেসব ডাক্তারবাবু শুধু প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন, তাঁদের হয়েছে শাঁখের করাত। চেম্বারে বসলে অর্থপিশাচ বলে গালি শুনতে হবে, না বসলে “বিপদের সময় লোকটা গাঢাকা দিলো”।

সব থেকে খারাপ অবস্থা মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ আর যেসব ডাক্তার মুখমন্ডল নিয়ে কাজ করেন তাঁদের। মানে নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞ, চক্ষু বিশেষজ্ঞ আর দন্ত চিকিৎসকরা। ইএনটির স্পেশালিষ্টদের তো সন্দেহজনক রোগীদের গলা থেকে টেস্ট করার জন্য সোয়াব শুদ্ধ নিতে হচ্ছে। সব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের জন্য যে পরিমাণ পিপিই কিট লাগবে তা যোগান দেওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে ঢাল-তলোয়ার বিহীন নিধিরাম সর্দার হয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে।

অভাবটুকু সাহস দিয়ে ঢেকে কাজ চলছে। যে কাজ করতে অন্তত দশজনের প্রয়োজন হয়, সেকাজ একাই অনেকে করছেন। মেডিসিনের এক চিকিৎসক। অল্প বয়সী। দুটো মিষ্টি মিষ্টি বাচ্চার বাবা। প্রথমদিন থেকেই করোনা যোদ্ধা। একদিন ঠাট্টার ছলে বলেছিলাম, “খুব ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যাচ্ছে না ভাই?” সে বলেছিল তুমি কি বলছো দাদা, এতোগুলো মানুষ এরকম একটা মহামারীর মুখে পড়েছে। তাদেরও তো সন্তান আছে। মানুষ বাঁচানোর লড়াই তো চালাতেই হবে।”

আমার সেই ভাই কলকাতার একটি নামকরা হাসপাতালে এখন ভর্তি আছে। খুব খারাপ অবস্থা তাঁর। জানি, অল্প কিছু অসহিষ্ণু লোকের বাইরে অধিকাংশ ভালো মানুষ আছে। যারা মেডিসিনের সেই ডাক্তারটির জন্য যে যার নিজের দেবতার কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছেন, যেন ভালো হয়ে ফিরে আসে সে। তবে যে যাই বলুক, তোমাকেই যে মহামারীর বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়তে হবে ভাই। “মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,/দিক্‌-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা—/ তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,/এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।”

FacebookTwitterShare

Leave a Reply Cancel reply