দক্ষিন কলকাতার বুকে টালিগঞ্জ এর কাছে ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য খোলা হল নয়া আস্তানা
HnExpress ২রা সেপ্টেম্বর, জয় গুহ, কলকাতা ঃ “A Trans Place To Rest”, এ যেন মাতৃহারা, সংসারের মার খেতে খেতে দিশেহারা নট সম্রাট গিরিশ ঘোষের গলায় গেয়ে ওঠা আর্তনাদ, গানের কলি হিসাবে বেড়িয়ে আসা সেই কথা। সম্প্রতি দক্ষিন কলকাতার বুকে টালিগঞ্জের কাছে তৃতীয় লিঙ্গ বা ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য খোলা হল এক নয়া আস্তানা
“জুড়াইতে চাই, কোথায় জুড়াই, কোথা হতে আসি, কোথা ভেসে যাই”। গ্রামে বা শহরের বারবনিতারাও দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, শুধু দক্ষিনেশ্বরের “পাগল পুরুত” রামকৃষ্ণের দরজা ছিল খোলা “মাতাল তো কি হয়েছে”- পরম মমতায় কাছে টেনে নিলেন পরমহংস। গিরিশ ঘোষের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল সেই চাওয়া পাওয়ার হিসাব বিহীন আশ্রয়।
তফাৎ কোথায় ? শৈশবে যখন শিশুরা মা বাবার হাত ধরে পায়ে পায়ে বড়ো হয়, তখন তাদের রূপান্তরের দিকে হাঁটতে চাওয়া সন্তানদের হাত ছেড়ে দেয় পিতা-মাতা। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ২০১৯ সালের রিপোর্ট বলছে, বয়ঃসন্ধির পরে মাত্র ২٪ রূপান্তরকামী কিশোর কিশোরী পরিবারের সাথে থাকার অধিকার পায়। অথচ শিশু অধিকারের আন্তর্জাতিক দাবী অনুযায়ী এইটুকু তো সকল শিশুর অধিকার।
সেই যে ছোটা শুরু হল, মৃত্যুর কাফন গায়ে ওঠা পর্যন্ত সেই ‘জুড়াইতে’ চাওয়ার মত একটা ‘আস্তানা’র খোঁজ চলতেই থাকে তাদের মনের মধ্যে, যেখানে আবারও অপব্যবহার হতে হবে না কাউকে। দক্ষিন কলকাতার বুকে টালিগঞ্জের আনোয়াসা রোডে খোলা হল সেই আস্তানা, যেটা রূপান্তরকামী ভাইবোনেদের জিরোনোর জায়গা।
হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সেই সকল সহৃদয় সংস্থা, মানুষরা, বন্ধুরা, যারাও কোথাও না কোথাও এই আশ্রয় না পাওয়ার বেদনা অনুভব করতে পেরেছিলেন। তাদের সারা জীবন ধরে ভেসে যাওয়া চোখের জল, হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে এগিয়ে চলার সেই অসীম চেষ্টার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। যাকে এক কথায় একটা Power Charging Station বলতে পারা যায়।
জীবনের হ্যান্ডসেটে যখন নিভে যাওয়ার লাল আলো দপ দপ করে তখন কিছুদিন জিরোনোর Short Stay হোম এই আস্তানা।
তারই মাঝে একটু স্বনির্ভর হওয়ার প্রশিক্ষণ।
আহত, ক্ষতিগ্রস্ত, ক্ষতবিক্ষত দেহ, মনের শুশ্রুষার জন্য যে সকল বন্ধু চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন যাদের সাহায্য পেয়েছেন তাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ জানায় তাঁরা, যারা সমাজের কাছে বিভক্ত হয়েছে তৃতীয়লিঙ্গ নামে পরিচিতি পেয়ে।
আর এই সেই আবাস্থলের এক কথায় নাম দেওয়া হয়েছে “আস্তানা”।
করোনা কালে দূরত্ব বিধি মেনে গোনা-গুনতি কিছু মানুষকে নিয়ে, মাতৃস্নেহে আপন করে নেওয়া নৃত্যগুরু এবং সমাজসেবী অলোকানন্দা রায়ের হাতে খোলা হল “আস্তানার” সেই পরম সিংহদুয়ার। এই শেল্টারের জন্য বছরের পর বছর ধরে সরকারের কাছে আবেদন করে করে, অবশেষে ব্যক্তি উদ্যোগেই প্রথম পা ফেলা হল। তাঁরা আশা করছে, ধীরে ধীরে সবাই নিজেদের ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, মমতা দিয়ে ভরিয়ে দেবেন শহরের এই নতুন “আস্তানা”কে।
তিন বছর আগের ভরা বৈশাখে নন্দন চত্বরের অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু তার পরের টানা তিনদিন রাণুছায়া মঞ্চে ধর্নায় বসে বাংলার রূপান্তরকামী বাস্তুচ্যুত ভাই বোনেরা সকল পথের, মতের তথাকথিত সিস জেন্ডার সহনাগরিকদের যে ভালোবাসা পেতে শুরু করে, আজ তারই ভালোবাসা স্বরূপ হিসাবে “আস্তানা”র ছাদ হয়ে উঠল তাদের কাছে স্বপ্ন।
সব রঙের দরজায় দরজায় হাতজোড় করে ঘুরে ঘুরেও যখন শেল্টার হোম তৈরীর কোনো দিশা পাইনি, তখন তারা হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সাধারণ মানুষের কাছে। ভাবতেই পারেনি এতো মানুষ তাঁদের কাজকে অলক্ষ্যে থেকেও দেখেছেন, তাঁদের ভালোবেসেছেন, ভালোবাসা উপুড় করে দিয়েছেন। কেউ মাসের ভাড়ার দ্বায়িত্ব নিয়েছেন, তো কেউবা আসবাব পত্রের, তো কেউ স্বাস্থ্য পরিষেবার অঙ্গীকার, তো কেউ রুটিরুজির ভরসা জুগিয়েছেন।
আন্দোলন কে মুলস্রাতে বা মেইন স্ট্রীমে আনার কথা শুনেছি আজন্ম, আস্তানা আজ তা করে দেখাল বাস্তবে। হাজারো বৈষম্য, হাজারো নিগ্রহ, হাজারো না পাওয়াকে আদরের আস্তানা দিয়ে জুড়িয়ে দিল সবাই। আস্তানা আজ আর শুধু তাদের স্বপ্ন নয়, শুধু ট্রান্সজেন্ডার ভাই বোনেদের গল্প নয়, আস্তানা আসলে সেই লাইনটা…..”ভায়ের মায়ের এতো স্নেহ, কোথায় গেলে পাবে কেহ”—