মানুষ রূপী একদল নরখাদক ধর্ষক
HnExpress নূপুর সাহা, বিশেষ প্রতিবেদন ঃ একবিংশ শতাব্দীতে এসে যেখানে চন্দযান ‘বিক্রম’ চাঁদের মাটি স্পর্শ করতে চাইছে, সেখানে পৃথিবীতে বসে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের জীবন কেন দুর্বিষহ হয়ে চলেছে তার কার্যকারন অনুসন্ধান ও সমাধানের সময় যদি আজও না উপস্থিত হয়, তবে খুব তাড়াতাড়ি পৃথিবী নামক গ্ৰহ থেকে মান ও হুশ শব্দটা উবে যাবে। আর শুধুই পরে থাকবে অমানুষ শব্দটি, একদল থাকবে ধর্ষক রূপে নরখাদক চাবুক মারার জন্য আর এক দল নীরব থেকে ধর্ষিতা হয়ে আজ্ঞাবহ ভৃত্যের মত শুধু মার খাবে, অনেকটা সেই মধ্যযুগের ক্রীতদাসদের মতো।
আজ যে ভাবে নারীদের নৃশংসতার সাথে ধর্ষণ করে খুন করছে এক শ্রেণীর নরপিশাচ, এটা যেমন কখনোই কাম্য নয়, তেমনি শিশু পাচার, যত্রতত্র মাদকের নেশাগ্রস্ত বহুল ব্যবহার, মানব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে অবাধ ব্যাবসা, শিশু শ্রম, খুন- রাহাজানি প্রভৃতি সকল কাজই সুস্থ সমাজের পক্ষে কাম্য নয়। যখন কোন বড়ো রকমের নৃশংস ঘটনা ঘটে, শুধু তখনই আমরা শিউরে উঠে নানা ধরনের মন্তব্য করি, নানান বিধান দিতে থাকি, কিন্তুু কোন ভাবেই কি এই অপরাধমূলক কাজকর্ম বন্ধ করার জন্য কোনো কড়া আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে?
উল্টে আরো মারাত্মক আকার ধারণ করে এই অপরাধ প্রবণতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। কেউ কেউ মনে করেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলেই এই সব বন্ধ হয়ে যাবে চিরতরে, কিন্তু সত্যি কি তাই! হ্যা অপরাধ যে করে আর অপরাধ যে সহে দুইই সমভাবে দোষী। তাই শাস্তি নিশ্চিত ভাবেই চাই, এবং তা অংশ দৃষ্টান্তমূলক। এখন দেখার বিষয় সারা পৃথিবীতে এই অপরাধমূলক কাজ কি সর্বত্রই সমান ভাবে চলছে? অনুসন্ধানে পাই— না , অনুন্নত দেশেগুলিতে উন্নত দেশের তুলনায় অপরাধ প্রবণতা অনেক বেশি।
কারন অনুসন্ধান করলে দেখতে পাবো যে, চরম দারিদ্র্যতার মাঝেই সঠিক শিক্ষার অভাব, বেরোজগারি অবস্থা, নারী পুরুষের প্রতি সঠিক সামাজিক জ্ঞান এর অভাব, নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখিয়ে চলচিত্র ও বিজ্ঞাপন গুলির যথেচ্চ নিন্দনীয় ভূমিকা, যথেচ্চ পরিমানে মাদকের প্রাচুর্যতা ও যুব সমাজের কাছে তা সহজলভ্য করে দেওয়া এবং সামাজিক অবক্ষয় ও অবনতি এর মূল কারণ হিসেবে বলতে পারি।
এর সাথে সত্যিকারের ভালো দেশনায়ক বা দেশনেত্রীর অভাব, এই অপরাধ গুলোকে উস্কে তা নিরন্তর, অনবরত ঘটানোর জন্য দায়ী। দেশ সেবকরা দেশ সেবার নাম করে যে ভাবে এই সমাজের দরিদ্র, দুর্বল, অসহায় কম বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষগুলিকে তাদেরই স্বার্থে যে ভাবে পশুর মতো ব্যবহার করছে তার পরিপ্রেক্ষিতে বলতেই পারি — ” রাষ্ট্রের কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখতে দেশের শাসক দল যুগে যুগে এমন ঘৃন্য কাজকে ইন্ধন যোগাচ্ছে, যার ফল স্বরূপ মানুষরূপী নরপিশাচদের পাশবিক শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে”।
পরিবর্তিত যুগে দাঁড়িয়ে সর্ব শ্রেণীর মানুষের জন্য যদি সত্যিকারের পরিবর্তন না আসে তবে এই ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চলতেই থাকবে। তাই সর্ব প্রথম চাই দারিদ্র দূরীকরণ, জন্ম নিয়ন্ত্রণ, মানুষের সার্বিক জীবন যাপন এর মান উন্নয়ন যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসম্মত শারীরিক ও মানসিক উভয় ক্ষেত্রেই সর্ব জনহিতকর কর্মসূচি রূপায়ণ করে তার প্রয়োগ ও কঠোর ভাবে সমাজের জন্য ক্ষতিকর কাজ কর্মকে শক্তভাবে দমন করা, তবেই সমাজ সুন্দর ও অপরাধ মুক্ত হবে বলে বিশেষজ্ঞ ও নেটিজেনদের মতামত।
অনবরত ঘটে চলা অপরাধ, যা কিনা আজ সুস্থ সমাজের পক্ষে অতিব ক্ষতিকর, তেমনি একটি উন্নয়নশীল দেশের পক্ষেও তা মারাত্মক নিন্দনীয় ও লজ্জাজনক বিষয়। সকল পুরুষ মানুষ যেমন ধর্ষক হয় না তেমনি সকল ধরনের অপরাধমূলক কাজকর্মের জন্য বিশেষ কোনো জাতি, ধর্ম, বা বর্ণ কে দায়ী করা ঠিক নয়। আমরা যদি ইতিহাসের পাতা খুলি, দেখতে পাবো যুগে যুগে ধর্ষকের চেহারা বদলেছে , পরিকল্পনা বদলেছে, কিন্তু বিজ্ঞানের এতো আবিষ্কার সবই বৃথা মনে হয়েছে যখন দেখেছি, উন্নয়নের সর্ব শিখড়ে এসেও সার্বিকভাবে মানুষের মননের – চেতনের কোন পরিবর্তন হয়নি।
মধ্যযুগে ‘দেবদাসি’ প্রথা, পরবর্তীতে ‘গণিকা বৃত্তি’ সবই ছিল, অনেক বৈদেশিক জাতি এ দেশের মেয়েদের উপর অত্যাচার চালালেও এই নিয়ে সমাজে তেমন কোন ভয়ের উদ্বেগ হয়নি, কারণ মানুষ তখনও একজোট হয়ে সমাজকে রক্ষা করার নিমিত্তে তথা দেশকে রক্ষা করতে ঝাপিয়ে পড়তে জানতো, কিন্তু স্বাধিনতার প্রাক্ মুহুর্ত থেকে দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে যে ভাবে দেশ ভাগের নামে হিংসা ছড়ানো হয়েছে ও নারিদের ধর্ষিত হয়ে সর্বশান্ত হতে হয়েছে, সাম্প্রতিককালের এইসব ঘটনাপ্রবাহ সেটাও ছাপিয়ে গেছে।
প্রকৃত অনুসন্ধান বা সার্ভে করলে মিলবে শুধু এই চারজনই নয়, শয়ে-শয়ে, হাজারে হাজারে ধর্ষক ঘুরে বেড়াচ্ছে এই সমাজে, জনগণের কাছে প্রশ্ন রইলো প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে যে, ঠিক কত জনকে ফাঁসি দিলে এই সমাজ ধর্ষক মুক্ত হবে? বাস্তবিক কোন পুরুষই ভূমিষ্ট হয়ে ধর্ষক হয় না, কিন্তু এই সমাজের নোংরা জঞ্জাল যুক্ত দূষিত পরিবেশ তাকে হিংস্র পশুতে পরিনত করে। এক কথায় রাষ্ট্রের অবহেলা ও স্বদিচ্ছার অভাবেই এদের এত বাড়বাড়ন্ত। তাহলে সূক্ষ বিচারের ফল কি হবে, ধর্ষক কারা ?
সাথে এটাও বলব যে, শুধুমাত্র এনকাউন্টার ধর্ষণ বন্ধ করার জন্য কোন স্থায়ী সমাধান নয়, কেননা এতে অনেকটাই ঝুঁকি থাকে আসল অপরাধীর বদলে নির্দোষের মৃত্যু হয়ে যাওয়ার, সুস্থ সমাজের পক্ষে এধরনের হঠকারি সিদ্ধান্ত কখনোই সমর্থন যোগ্য নয়, এতে বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা নষ্ট হয়ে ক্রমে সমাজে পুলিশিরাজ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে ভবিষ্যতে, তা একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় কখনোই কাম্য নয়।
আর সার্বিক ভাবে চেতনার বিকাশ, মূল্যবোধ, আত্ম সংযমের মানসিকতা তৈরি করতে না পারলে, সমাজের মানুষদেরকে শুধু ভোগবাদী পণ্যের অভিমূখে ঠেলে দিতে চাইলে, মানুষের বিবেক বুদ্ধি ক্রমশঃ লোপ পেয়ে যে হিংস্র পশুতে পরিনত হবে এটাই কি স্বাভাবিক নয়! যেমন করে সবল সিংহ দুর্বল হরিণ কে হত্যা করে, তেমনিই হতে থাকবে এ সমাজে নারীদের সাথে। ধর্ষণ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, অনেক গুলি জঘন্যতম অপরাধের মতোই সামাজিক ব্যাধি, এর ভয়াবহতার নৃশংস রূপ বর্তমান প্রজন্মকে যদি সার্বিক ভাবে এখনো নাড়া না দেয়, তবে সেই দিন দূরে নয়, যখন এই সুস্থ সমাজের পরিকাঠামো ভেঙে সমাজের বুকে শুধুই বিশৃঙ্খলতা বিরাজ করবে।
ধর্ষণের মতো গভীরভাবে মানসিক আবেগ তাড়িত নোংরা বিক্রিয়া বন্ধ করতে হলে সমাজ সেবকদের যেমন ভূমিকা আছে, তেমনি সেই ভুমিকার জন্য সরকারের ও সর্ব জনহিতকর কর্মসূচি রূপায়ণ করে তা বাস্তবায়ন করার সদিচ্ছা থাকা প্রয়োজন। সারা বছর ব্যপী নানান সমাজ সচেতনতা, সেল্ফ ডিফেন্স, গুড টাচ্- ব্যাড টাচ্ কর্মসূচি রূপায়ণ করে, স্কুল কলেজের পাঠ্যসূচিতে ‘সেক্স এডুকেশন’ সম্বন্ধে ধারণা প্রদান করে প্রভৃতি জনহিতকর কর্মসূচি পালন করার মাধ্যমেই সমাজ থেকে এই ব্যাধি দূর হতে পারে । কিন্তু “বিড়ালের গলায় ঘন্টাটি কে বাঁধবে “? যখন কিনা সর্ষের মধ্যেই তো ভুত!