CM সরকারি খরচের বাহুল্য নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্ন এবং কিছু কথা

0

HnExpress ২৭শে জানুয়ারি, আশোক সেনগুপ্ত, কলকাতা : ২০১১ সাল। রাজনৈতিক পালাবদল হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে (West Bengal)। অনেক স্বপ্ন সদ্য মুখ্যমন্ত্রী হওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখ জুড়ে। জেলার প্রত্যন্ত প্রান্তে পৌঁছিয়ে দিতে হবে সরকারের সমস্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা (Health Service)। আর এটা করতেই হবে। কারণ, নির্বাচনী ভাষণে যে এটাই ছিল তাঁর অন্যতম প্রধান আশ্বাসবাণী। 

কী হল তারপর? রাজ্যের জেলায় জেলায় তৈরি হল সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল (Super Speciality Hospital)। বিরাট ঝাঁ চকচকে সব ভবন। এল দামী দামী সব যন্ত্রপাতি। অনেকে ভাবলেন, যাক! এতদিনে বাঁচা গেল। কথায় কথায় আর জেলাসদর বা কলকাতার হাসপাতালে ছুটতে হবে না।মুখ্যমন্ত্রীও (Chief Minister) নির্দেশ দিলেন, আর  রোগী রেফার করা চলবে না। 

২০১৫-র ২১শে জানুয়ারি ‘দি মিন্ট’ (The Mint) লিখেছে, ৩৪টি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল তৈরি হয়েছে। খরচ হয়েছে প্রায় ২,৩০০ কোটি— ২,৪০০ কোটি টাকা। এর প্রায় সবটাই (২,১০০ কোটি টাকা) কেন্দ্রের (Central) থেকে আসা বরাদ্দ টাকা। যা এসেছিল অনগ্রসর অঞ্চল উন্নয়ন তহবিল (BRGF) খাতে। 

রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব তখন মলয় কুমার দে। প্রকাশ্যেই তিনি এটিকে অত্যন্ত সৎ প্রচেষ্টা বলেও এর সার্থকতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। আজ এতদিন বাদে তিক্ত অভিজ্ঞতার নিরিখে অনগ্রসর অঞ্চলের বাসিন্দাদের একটা বড় অংশ অনুভব করছেন এত বিপুল পরিমান অর্থে তৈরি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালগুলো (Super Speciality Hospitals) কেন সত্যিকারের পরিষেবা দিতে পারল না। 

এ নিয়ে সাতকাহন লেখা যায়। কিন্তু  এটা একটা নিছক উদাহরণ। মুখ্যমন্ত্রীর (Chief Minister) সদিচ্ছা সত্বেও ব্যর্থ হল বিপুল অর্থের কার্যকারিতা। কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি (Machine) কম ব্যবহৃত হয়ে আজ তা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অচল, বা প্রায় অচল হয়ে গেল। চিকিৎসকদেরও শহর থেকে গ্রামমুখী করা গেল না। সর্বোপরি কর্মসংস্কৃতির চরম অভাব। 

১৮ই জানুয়ারি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) নবান্নে সরকারি খরচের বাহুল্য নিয়ে প্রশ্ন তুললেন।কোনও প্রশাসনিক বৈঠক বা সভায় কেন এত খরচ হচ্ছে জানতে চাইলেন। কিছু জেলায় আগের প্রশাসনিক বৈঠক-বাবদ কয়েক কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে জেনে তিনি কড়া নির্দেশ দিলেন ব্যয় সঙ্কোচের। আরও অনেক কথা বললেন। সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতার নিরিখে তখনই মনে হল, মুখ্যমন্ত্রী (Chief Minister) ভুল বলছেন না। বাড়তি খরচের কী প্রয়োজন? কিন্তু গত এক যুগে বাস্তব ছবিটা কীরকম? তখনই মনে পড়ল গণ্ডায় গণ্ডায় তৈরি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালগুলো (Super Speciality Hospital) কতটা কার্যকরী হয়েছে। 

বিভিন্ন সভা-সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী (Chief Minister) হিসেব দাখিল করেন  রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় কত কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। আমি খবর রাখি। দায়িত্ব নিয়ে লিখছি এরকম অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের হাল খুব খারাপ। পূর্ণ সময়ের শিক্ষক ও আধিকারিক প্রায় নেই। করিতকর্মা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসারেরা এই সব প্রতিষ্ঠানে পদ ধরে রেখেছেন।  অনেকে থাকেন কলকাতায়। মাঝে মাঝে দায় সারেন কর্মক্ষেত্রে পদার্পন করে। আর উপাচার্য (Vice Chancellor) নিয়ে যা চলছে, সেগুলো নিয়ে লিখলে তো রীতিমত মহাকাব্য হয়ে যাবে।  

গত এক যুগে নয়া উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরির জন্য সরকার খরচ করেছে বহু হাজার কোটি টাকা। তার প্রায় প্রতিটাই ধুঁকছে। অথচ, এই সময়কালে তৈরি বেসরকারি নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (Educational Institution) ছুটছে রমরমিয়ে। স্বাস্থ্য-শিক্ষার পাশে যে গোলার্ধটা প্রথমেই মাথায় আসে তা হল বিচার। গত এক যুগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তহবিল থেকে কত মামলার জন্য বিভিন্ন খাতে মোট কত কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে, তার হিসেব কে রাখেন? আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, ১৪ আনা মামলাতেই হেরেছে রাজ্য সরকার (State Government)। এই বিষয়টা নিয়েও লিখলে মহাভারত লেখা হয়ে যাবে। 

একদিকে ব্যয় সঙ্কোচের নির্দেশ, অন্যদিকে গাদাগুচ্ছের বশংবদ আমলাকে অবসরের পর রেখে দেওয়ার বেতন ও আনুষঙ্গিক ব্যয়, কিছু ক্ষেত্রে তাঁদের নতুন বাসস্থানে বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে আমলা মহল থেকেই। উদাহরণ হিসাবে উঠে এসেছে এক অবসরপ্রাপ্ত আমলার জন্য পার্ক সার্কাসে সরকারের (Government) অধীন একটি বাড়ি সংস্কারে বিপুল অর্থ বরাদ্দের কথা। অনেক আমলা ২-৩টি পদে আসীন। তাঁদের জন্য পুষতে হচ্ছে পৃথক অফিস এবং পৃথক ছোটখাট সচিবালয়। প্রশ্ন উঠেছে, ব্যয় সঙ্কোচের ভাবনায় কি এগুলো আসতে পারে না?

২০১৩-‘১৬ রাজ্যের সরকারি কর্মীদের  সংগঠন কো-অর্ডিনেশন (Co-ordination) কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মনোজ কান্তি গুহ। এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে এই  প্রতিবেদককে বলেন, “১৯৭৪ সালে আমি সরকারি কাজে ঢুকি। এখনকার মত বিপুল পরিমাণ অপচয় তখন তো বটেই, বাম আমলের শেষদিকেও ভাবাই যেত না। মুখ্যমন্ত্রী (Chief Minister) প্রশ্ন করছেন সরকারি খরচের বাহুল্য নিয়ে। তা তিনি বিভিন্ন ক্লাব, পুজো কমিটি, পুরোহিত, ইমাম, শিল্পীদের জন্য বছরে কী বিপুল পরিমান অনুৎপাদক খয়রাতি দিচ্ছেন, তার হিসেব কে রাখেন?”

মনোজবাবুর কথায়, “সরকারি (Government) কর্মীদের কাছ থেকে মাসে ৫০০ টাকা করে কেটে নেওয়া হয় স্বাস্থ্য খাতে। সব মিলিয়ে বিপুল অর্থ জমা হয় সরকারের তহবিলে। অথচ, কর্মীরা ভাল চিকিৎসা পান না। মুখ্যমন্ত্রী (Chief Minister) নিজে খেয়াল খুশিমত সরকারের টাকা, মানে জনগনের টাকা খরচ করবেন। আর বৈঠকে বাজে খরচে রাশ টানার চেষ্টা করবেন— কী করে সেটা সম্ভব?” তবে, দিনের শেষে মুখ্যমন্ত্রীর সদিচ্ছাটাকেই সৎ বলে মনে করেন অনেকে। কারণ, লক্ষী চঞ্চলা। কুজোর জল গড়িয়ে খেলেও শেষ হয় একদিন। 

আর কর্মসংষ্কৃতি তো তলানিতে এসে ঠেকেছে। বেতন দিতে তহবিল (Fund) প্রায় ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ সরকারি দফতর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পুরসভার কর্মীরা এখনও কাজ করেন ‘আসি যাই, মাইনে পাই’ মানসিকতায়। যে কাজ করবে না, রাজনীতির উর্দ্ধে উঠে তাঁকে বসিয়ে দেওয়া বা ঘাড় ধরে কাজ করানোর ক্ষমতা মুখ্যমন্ত্রীর (Chief Minister) নেই। হয়ত দেশের অধিকাংশ রাজ্যেই এই ছবিটা এরকমই। সুতারাং এটা বলাই বাহুল্য যে সরকারের ব্যয় সঙ্কোচে মুখ্যমন্ত্রীর কড়া নির্দেশ অন্য অনেক কথার মতই রয়ে যাবে নিছকই তাঁর আপ্তবাক্য হয়ে।

FacebookTwitterShare

Leave a Reply Cancel reply