বৌদ্ধ-হিন্দু যুগের অনুপম স্থাপত্য : রহস্যময় জটার দেউল

HnExpress সুমিত কুমার বৈদ্য, একটু অন্যরকম ঃ সময় সততই চলমান। সে এগিয়ে চলে যৌবনা নদীর মতো। কোন পিছুডাক তার চলাকে স্তব্ধ করতে পারেনা। পুরাতন রয়ে যায় স্মৃতির গভীরে। সময়ের স্রোতে ভেসে যেতে যেতে পুরাতনের স্মৃতিচারণ ও চর্চাই হলো ইতিহাস। নতুন্ত্বের যাদুঘর আমাদের ভারতবর্ষ এর বঙ্গপল্লীর অলিতে গলিতে ইতিহাসের রহস্য গুন্ঠনবতী হয়ে লুকিয়ে আছে। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এমনই এক রহস্যাবৃত ইতিহাস আমাদের আজকের আলোচ্য, “জটার দেউল।”
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার শেষপ্রান্তে রায়দিঘি থানার অন্তর্গত কঙ্কন দিঘির কাছেই ১১৬ নং লটে অবস্থিত প্রায় ৩০ মিটার লম্বা এই ইটের মিনারটি, যা জটার দেউল নামেই পরিচিত। অনুমান করা হয়, পাল যুগে এই মিনারটি নির্মিত। বর্তমানে স্থানীয় লোকজন এটিকে শিব মন্দির হিসাবেও পুজো করে থাকেন।
যদিও মন্দিরের গর্ভগৃহে উঁকি দিলে অন্যান্য শিব মন্দিরের মতো এখানে কোনও শিবলিঙ্গের দেখা মেলে না। তবে গর্ভগৃহের অভ্যন্তরে কয়েকটি পোড়া মাটির মূর্তি দেখা যায় মাত্র। আরও আশ্চর্য যে, সুন্দরবনের এই গহীন জঙ্গলে কোথা হতে এত সুপ্রাচীন পোড়া ইটের দেউলটি এল? ভারতবর্ষে যেক’টি হাতে গোনা ইটের দেউল রয়েছে তাদের মধ্যে জটার দেউল অন্যতম। কেন্দুলিতে অজয় নদীর দক্ষিণে অবস্থিত ইছাই ঘোষের দেউল এবং বাঁকুড়া জেলার সিদ্ধেশ্বর মন্দিরের দেউল দু’টির সঙ্গে এর গঠনশৈলীর সাদৃশ্য চোখে পরার মত।
২০১১ সালের শেষদিকে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্বাধানে এখানে খননকার্য হলে এই দেউলটির সামনে একটি ইটের কাঠামোর প্রকাশ মেলে। এই ইটের কাঠামোটি ভালভাবে দেখলে বোঝা যায়, এটি একটি নাট মন্দিরের কাঠামো। মনে করা যেতে পারে, পূর্বে এই দেউলটির সামনে একটি নাট মন্দির ছিল যেটি পরবর্তী কালে মাটির তলায় চাপা পড়ে গেছে।
দেউলটির গঠনশৈলী এবং সামনে নাট মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ— এটির সঙ্গে বৌদ্ধ যোগসূত্রকে যেন নির্দেশ করে। তার সঙ্গে আরও আশ্চর্য লাগে এটি শিবমন্দির রূপে পূজিত হলেও গর্ভগৃহে সেভাবে শিবলিঙ্গ নেই। তাহলে এই দেউলটি প্রকৃতপক্ষে কী?
যেকোনো রকমের খবর ও বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন ঃ ৮২৪০৯০২৪৪৫
কথিত আছে একটি প্রাচীন তাম্রশাসন অনুযায়ী ৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি জনৈক সামন্তরাজা জয়চন্দ্র এই দেউলটি নির্মাণ করেছিলেন। কেউ কেউ এটিকে প্রতাপাদিত্যের যুদ্ধ জয়ের স্মারক হিসাবেও উল্লেখ করেন। আবার লোকশ্রুতি রয়েছে, রাজা লক্ষণ সেন বখতিয়ার খিলজির কাছে পরাজিত হয়ে পূর্ববঙ্গে পলায়নের সময় এই দেউল মঠেঅ কিছুদিন আত্মগোপন করে ছিলেন। এই বিভিন্ন লোকশ্রুতি এই দেউলটির প্রাচীনত্ব নির্দেশ করে, কিন্তু সঠিকভাবে এর স্থপয়িতার পরিচয় নির্দেশ করে না।
এই দেউলটির আশপাশের এলাকা থেকে কিছু পৌরাণিক মূর্তি যেমন বটুক ভৈরব, ব্রোঞ্জের মহাকাল মূর্তি, পোড়ামাটির তারামুর্তি পাওয়া গেছে। এই জনপদের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নাথ বা যুগি সম্প্রদায়ের বসবাসও লক্ষ্য করা যায়। তাহলে একথা বলাই যায় এই ম্যানগ্রোভ বিধৌত অঞ্চলে প্রাচীন কালে নাথ ধর্মের প্রসার ঘটেছিল অথবা নাথ ধর্মিরা কোনো বিশেষ কারনে এই অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। নাথ বা যুগি সম্প্রদায়ের আরাধ্য হলেন গোরক্ষনাথ বা শিব। তাহলে আশপাশের অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত অন্যান্য মূর্তিগুলির ব্যাখ্যা কী?
পাল যুগের শেষ দিকে বৌদ্ধ ধর্মের অবক্ষয় শুরু হয়। এই ধর্মের উপর তন্ত্রের প্রভাব পড়ে। নাথ যোগিরা তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের সাথে জড়িয়ে পড়ে। যদিও আদিতে এঁরা গোরক্ষনাথ বা শিবের উপাসক ছিলেন, পরবর্তী কালে সহজিয়া সাধকে তাঁদের রূপান্তর ঘটে। পাল যুগের সমাপ্তি ও সেন যুগের বিকাশের ফলে বাংলায় পূনরায় ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পুনরুত্থান ঘটে। ফল স্বরূপ সহজিয়া নাথপন্থীরা শৈব হিন্দুতে নিজেদের রূপান্তর ঘটায়। যার ফলে জটার দেউল পরবর্তীকালে জটাধারী শিবের মন্দিরে পরিনত হয়।
বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নির্দশন চর্যাপদ আবিষ্কার পর্বে বাংলার ইতিহাসের একটা দিক যেমনভাবে প্রতিফলিত হয় যে, হিন্দুধর্মের প্রভাবে সহজিয়াপন্থীদের সুদূর পার্বত্য অঞ্চলে আত্মগোপনের এক করুণ কাহিনি। এবং পরবর্তীকালে বাংলাভাষার প্রাচীনতম নিদর্শনের সন্ধান, ঠিক তেমনিভাবে সুন্দরবনের এই গহীন অঞ্চলে এই জটার দেউলও সহজিয়া নাথ পন্থীদের আত্মগোপনের এক করুণ ইতিহাসের দিক নির্দেশ করে।
কিন্তু যার পুরো কাহিনি আজও দৃশ্যমান নয়। হয়ত ভাবীকালে তা উন্মোচন হবে এবং চর্যাপদের মতো কোনও অমূল্য রত্ন আমাদের হাতে উঠে আসবে। তবে একটি কথা অনস্বীকার্য যে, প্রাচীন গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তনের কারণে নদী তীরবর্তী অনেক ঐতিহ্যময় স্থানের মতো জটার দেউলও রহস্যের চাদরাবৃত হয়ে রয়ে গেছে।