দু’হাজার কুড়িতেও এমন একটা দৃশ্য দেখতে হল! এক পিতা নিজের মুখেই বললেন ‘এমন সন্তান যেন কারোর কপালে না জোটে’—
HnExpress ৯ই জুন, বাপন ভূঞ্যা, পূর্ব মেদিনীপুর ঃ ছেলের সমন জারি, বাড়িতে খেতে হলে রোজ দিতে হবে ৩০ টাকা। না দিতে পারলে সেদিন উপোস! করোনার করাল গ্রাসে অসহায় বৃদ্ধ আজ কর্মহীন! বিধাতার অমোঘ লেখনিতে সত্তর বছরের পঙ্গু পিতার ঠাঁই এখন ভাঙাচোরা দালানে। পাপী পেটকে সচল রাখার উপায় পথ চলিত লোকের দেওয়া খাবার! পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলের এক বৃদ্ধের এ করুণ কাহিনী সমাজের নগ্ন রুপটা আরো প্রকট করে দিয়েছে। দু’হাজার কুড়িতেও যে এমন একটা দৃশ্য দেখতে হবে তা কে ভেবেছিল, এক পিতা নিজের মুখেই বললেন, ‘এমন সন্তান যেন কারোর কপালে না জোটে।’
সে অনেক দিন আগের কথা, ভাঙা ঘর আলো করল তিন সন্তান। একটি ছেলে, আর দুই মেয়ে। দাম্পত্যের পূর্নতার খুশি তাদের চোখে মুখে। জীবনের সমস্ত স্বাদ আহ্লাদকে বিসর্জন দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় হকারি করে ছেলে মেয়েদের মানুষ করলেন। জীবনের চক্রব্যূহে মেয়েরা পাড়ি দিয়েছে স্বামীর বাড়ি, ছেলেও ব্যস্ত নিজের সংসার নিয়ে। বৃদ্ধ ভেবেছিল ছেলের কাছে নাতি নাতনিদের নিয়ে বাকী জীবনটা আনন্দে কাটিয়ে দেবে।
কিন্তু বিধি বাম সাধল, ছেলে তো বৃদ্ধ পিতাকে আরো বড় উপহার দিল, ছেলে বিধান দিল তার কাছে থেকে খেতে গেলে রোজ দিতে হবে নগদ তিরিশ টাকা! সেটাও এক বেলার জন্য। বৃদ্ধর কথায়, পরে তিরিশ টাকা থেকে সেটা বেড়ে চল্লিশ টাকা হয়, কারন জিনিস পত্রের দাম যে বেড়েছে। দিশেহারা বৃদ্ধ মাথায় আইসক্রিম এর বাক্স আর হাতে চকলেট এর ব্যাগ নিয়ে বিভিন্ন স্কুলের সামনে রাস্তার মোড়ে মোড়ে হাঁক পাড়ত, আাইসক্রিম নাও, চকলেট নাও।
দুপুরের খাবার বলতে কোনো কোনো স্কুলের কিছু শিক্ষক শিক্ষীকাদের দেওয়া মিড ডে মিলের রান্না। কিংবা রাস্তার পাশে কেনো অনুষ্ঠান বাড়ির খাবার। রোদ বৃষ্টিও তখন ওর কাছে ফিকে! তাকে যে রোজগার করতেই হবে। না হলে যে তাঁর আদরের ছেলের কাছে রাতের খাবার জুটবেনা। করোনা আর আমফানের প্রভাবে রাস্তা ঘাট জন মানব শূন্য। তখন স্কুল, কলেজেও তালা। আইসক্রিম নাও চকলেট নাও সেই ডাকটাও বন্ধ। সেদিন লকডাউন কেড়ে নিল বৃদ্ধের বাঁচার শেষ রসদটাও!
না ওই বৃদ্ধ আর পারেনি ছেলের হাতে তিরিশ টাকা তুলে দিতে। খাবার বন্ধের সাথে বাড়ির দরজাটাও বন্ধ হয়ে যায়। তাই মূমুর্ষ বৃদ্ধ মাথা গোঁজার জায়গা করে নিয়েছে মহিষাদল রাজ বাড়ির ভাঙা দালানেই। রাস্তার লোকজন কিছু খাবার কিনে দেয়, তাই দিয়ে কোনেরকম চলে যায়। হয়তো কোনো সহৃদয় ব্যক্তির দেওয়া ছেঁড়া পাথনিতে কোনোরকমে পড়ে আছে। এই ভাবেই কেটে গেছে প্রায় দুমাস। না, ছেলে আর কোনো খোঁজ নেয়নি।
সংস্কৃতিতে একটা স্লোক আছে, পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাহি পরমং তপ। তবে এত স্লোক মাত্র, এটার মানেও হয়ত জানে না সে। বৃদ্ধ মানুষটির চোখের জল যেন জানান দিয়ে যায়, ছেলে তো ডাস্টবিনে কবেই ছুঁড়ে দিয়েছে। আর লকডাউন তার বাঁচার শেষ দরজাটাতেও তালা মেরে দিয়ে গেছে। ৮ই জুন লকডাউন কিছুটা লঘু হলেও স্কুল কলেজ তো সেই বন্ধই। তবুও সেই থমকে যাওয়া জীবনের প্রদীপ আবার জ্বলে ওঠার আশা নিয়ে অপেক্ষায় দিন গুনছে বৃদ্ধ।