বিতর্কিত কৃষি আইন পাশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে উত্তাল হচ্ছে সারা দেশ, ২৫ সেপ্টেম্বর দেশ জুড়ে “কিষান কারফিউ” বা “চাক্কা জাম” অভিযান
HnExpress ২৩শে সেপ্টেম্বর, অরুণ কুমার ঃ দীর্ঘদিন পর আবারো উত্তাল হতে চলেছে ভারতের রাজপথ। কৃষকদের বিক্ষোভ প্রতিবাদ আন্দোলন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে।
বিতর্কিত কৃষি আইন পাশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে প্রতিবাদ করতে আরম্ভ করেছে দেশের কৃষকদের একটা বড় অংশ। এই বিতর্কিত কৃষি ঋণের পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর সারা দেশে “কিষান কারফিউ” বা চাক্কা জাম” এর ডাক দিয়েছে কৃষকদের একটি সংগঠন, ভারতীয় কিষান ইউনিয়ন।
ইতিমধ্যেই সোমবার রাজধানী নয়াদিল্লিতে বিতর্কিত কৃষি আইনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে পরেন কৃষক সহ বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। ইউনিয়নের সর্বভারতীয় নেতা চৌধুরী রাকেশ টিকায়েত জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের এরকম কালা কানুনের বিরোধিতায় তারা আন্দোলন অব্যাহত রাখবেন। তিনি আরো জানিয়েছেন, “সরকার কৃষি পণ্য উৎপাদিত সামগ্রীর নিম্নতম ক্রয় মূল্য নির্ধারণ আইন” না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন জারি থাকবে।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার কৃষকদের বিরোধিতার বিক্ষোভ আন্দোলনের দিকে লক্ষ্য রেখেই এবছর উৎপাদিত কৃষিপণ্য সামগ্রিক একটি অন্যতম সমর্থনমূলক কথা ঘোষণা করেছেন। এবং সরকার এর পক্ষে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এই নূন্যতম সাপোর্ট প্রাইস সমর্থন মূল্য অব্যাহত থাকবে। এই প্রসঙ্গে চৌধুরী রাকেশ টিকায়েতের প্রশ্ন, তাহলে সরকার এ বিষয়ে আলাদা করে আইন তৈরি করছেন না কেন?
সোমবার থেকে নয়াদিল্লি, বেঙ্গালুরুসহ বিভিন্ন শহরে বিরোধীদের পাশাপাশি কৃষকরা বিক্ষোভ শুরু করেছে। অনতিবিলম্বে কৃষকের জন্য স্বার্থবিরোধী আইন বাতিলের দাবি জানিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। অপরদিকে এই কৃষি আইনকে ‘ঐতিহাসিক ও প্রয়োজনীয়’ আখ্যা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এদিকে, বিল পাশ নিয়ে বিরোধিতা ও হট্টগোলের কারণে রাজ্য সভার আট সাংসদকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধন’, ‘কৃষিপণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন’ এবং কৃষিপণ্যের এই দাম নিশ্চিত করতে ‘কৃষকদের সুরক্ষা ও ক্ষমতায়ন চুক্তি’ নামে রোববার রাজ্যসভায় পাশা হওয়া বিল তিনটিকে কৃষকদের মৃত্যুর পরোয়ানা আখ্যা দিয়েছেন বিরোধীরা। বিক্ষোভ চলাকালীন পুলিশ বাঁধা দিলে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তি হয়। ভারতীয় কিষান ইউনিয়ন তথা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির বক্তব্য, “কৃষিকে বেসরকারিকরণের মাধ্যমে বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দিলেই বরং কৃষকরা তাদের কাছে নিগৃহীত হবে।
যে কোনো সময় তারা পণ্যের গুণাগুণের দোহাই দিয়ে চুক্তি বাতিল করতে পারে। কৃষকরা তখন কোথায় যাবে? ফলে এই বিতর্কিত আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে সারা দেশ জুড়ে। উত্তরপ্রদেশ ছাড়াও হরিয়ানা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, বাংলা প্রভৃতি রাজ্যগুলিতে শুরু হয়েছে অরাজনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বিক্ষোভ প্রতিবাদ কর্মসূচি। কমিউনিস্ট পার্টিসহ বিরোধী নেতারা রাস্তায় নেমে মোদি সরকারের তীব্র সমালোচনা করছেন।
আইন বিরোধীদের দাবি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কৃষকদের দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির সুযোগ রেখে যে আইন পাশ করা হয়েছে, তার ফলস্বরূপ এই কৃষকদের ওপর কর্তৃত্ব বাড়াবে সব বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে সরকারের দাবি, আইন পাশের কারণে বড় প্রতিষ্ঠান ও ওয়ালমার্ট ডব্লিউ এমটিএনের মতো খুচরা বিক্রেতাদের কাছে কোন মধ্যস্থতাকারী ছাড়াই সরাসরি পণ্য বিক্রি করতে পারবেন কৃষকরা। আইনের পক্ষে সাফাই গেয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, এই আইন কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করবে।
এদিকে, রাজ্যসভায় কৃষি বিল পাশ করা নিয়ে বিরোধিতা ও হট্টগোলের অভিযোগে আটজন সাংসদকে চলতি সংসদ অধিবেশনের বাকি দিনগুলোর জন্য বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কৃতদের মধ্যে তৃণমূলের ডেরেক ও ব্রায়েন, দোলা সেন, কংগ্রেসের রাজীব শতাভ, রিপুন বরা ও সৈয়দ নাসির হুসেন, সিপিএমের কে কে রাগেশ ও এলাম আরাম করিম এবং আম আদমি পার্টির সঞ্জয় সিং রয়েছেন। বহিষ্কারের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সংসদ ভবনের বাইরে ধর্নায় বসেছেন বহিষ্কৃত আট সাংসদ-সহ বিরোধীরা।
কিন্তু এই বহিষ্কারের পরেও বিন্দুমাত্র দমতে রাজি নয় বিরোধী দলগুলো। কৃষক সংগঠন গুলোর সঙ্গে একাট্টা হয়ে দেশব্যাপী বড়ো ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে তাঁরা। আগামী ২৫ শে সেপ্টেম্বর
দেশজুড়ে “চাক্কা জাম” বা “কিষান কারফিউ” নাম দিয়ে সর্বাত্মক প্রতিবাদের ডাক দিয়েছে কৃষক সংগঠনগুলি। ওই দিন ভারত বন্ধের ডাক দিয়েছে সর্বভারতীয় কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি। তাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশে করেছে ১০টি ট্রেড ইউনিয়ন।
কিষাণ সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শাখার আহ্বায়ক এবং সিপিএমের কৃষক সভার নেতা অমল হালদার জানিয়েছেন, ২৫ সেপ্টেম্বর জেলা সদরগুলির গঞ্জ ও বাজার এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ হবে। পাশাপাশি জাতীয় ও রাজ্য সড়কে সাড়ে চার ঘণ্টা অবরোধ করা হবে। কৃষকদের প্রতিবাদে সমর্থন দেওয়ায় কংগ্রেসকে ধন্যবাদ জানান তিনি। অপরদিকে,পাঞ্জাবে শুক্রবারের কৃষক ধর্মঘটে সর্বাত্মক সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছে আম আদমী পার্টি।
তামিলনাড়ুতে কৃষকদের সঙ্গে মাঠে থাকবে বলে ঘোষণা করেছেন রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল ডিএমকে। ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে দলীয়ভাবে বিক্ষোভ কর্মসূচী শুরু করা হবে বলে জানান ডিএমকের প্রধান এম কে স্ট্যালিন। কংগ্রেস বিক্ষোভ শুরু করবে তার একদিন আগেই, মানে বৃহষ্পতিবার। কংগ্রেসের এমপি রাহুল গান্ধী ও প্রতাপ সিংহ বাজওয়া নেতৃত্ব দেবেন এদিনের দেশব্যাপী বিক্ষোভে। বৃহষ্পতিবার সারা ভারতে বিক্ষোভের পাশাপাশি ২ কোটি কৃষকভাই সহ সাধারণ জনতার গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করবে কংগ্রেস।
এই গণস্বাক্ষর প্রেসিডেন্ট রামনাথ কোবিন্দের কাছে পেশ করা হবে ১৪ই নভেম্বর, যেদিন জওহরলাল নেহেরুর জন্মদিন। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসও কৃষকদের আন্দোলনে পাশে থাকার ঘোষণা করেছে। কংগ্রেস নেতা কে সি বেনুগোপাল বলেন, ২রা অক্টোবর মহাত্মা গান্ধী ও লালবাহাদুর শাস্ত্রীর জন্মদিন। এই দিনটিকে ‘কৃষক ও কৃষি শ্রমিক বাঁচাও দিবস’ হিসেবে পালন করা হবে। এদিকে বিতর্কিত বিল দুটি প্রত্যাহারের দাবিতে ভারতের সব রাজ্য ও জেলায় প্রতিবাদী মিছিল, সমাবেশ হবে।
গত বেশ কিছুদিন ধরে মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র সহ ভারতের নানা প্রান্তে যে কৃষক বিক্ষোভ চলছে, তার নেতৃস্থানীয় ভূমিকাতে আছে রাষ্ট্রীয় কিষাণ মজদুর ইউনিয়ন। এই কৃষি বিলের বিরোধিতায় পথে নেমে প্রতিবাদে শামিল হচ্ছে বাম এবং কংগ্রেস। দুই দলের নানা সংগঠন ইতিমধ্যেই কৃষি বিলের প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমে পড়েছে। এবার তারা বৃহত্তর আন্দোলের পরিকল্পনা নিয়েছে বলে সুত্রের খবর। সংসদে পাশ হওয়া কৃষি বিলকে ‘কৃষকদের মৃত্যু পরোয়ানা’ বলে মন্তব্য করেছেন কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধী।
ওই বিলের বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে আন্দোলনের পরিকল্পনা করেছে কংগ্রেস ও ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়ন। হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এরাজ্যেও বৃহত্তর আন্দোলনে নামছে কংগ্রেস। জেলা পর্যায় থেকে শুরু হচ্ছে সেই আন্দোলন।
জানা গিয়েছে, ২রা অক্টোবর মহাত্মা গান্ধী এবং লালবাহাদুর শাস্ত্রীর জন্মদিনে কংগ্রেসের তরফ থেকে কৃষক ও কৃষি শ্রমিক বাঁচাও দিবস পালন করা হবে। প্রত্যেক রাজ্যের জেলা সদরগুলিকে এই আন্দোলনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানও চালানো হবে। প্রায় ২ কোটি কৃষকদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে জনহরলাল নেহরুর জন্মদিন ১৪ই নভেম্বর তুলে দেওয়া হবে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের হাতে। উল্লেখ্য, কৃষি বিলের প্রতিবাদে সোমবার রাজভবনের সামনে রাস্তায় বিক্ষোভ দেখিয়েছে যুব কংগ্রেস। এদিকে, কৃষিকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার নীতির প্রতিবাদে বিভিন্ন কৃষক সংগঠনের যৌথ মঞ্চ কিষাণ সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি আগামী ২৫শে সেপ্টেম্বর ভারত বন্ধ এবং দেশ জুড়ে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে।
ফসিটু, আইএনটিইউসি, এআইটিইউসি সহ কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলি এই প্রতিবাদকে সমর্থন করছে। অন্যদিকে, এই রাজ্যের
আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের সিপিএম কার্যালয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বামফ্রন্টের বৈঠকে ঠিক হয়েছে, তারাও কৃষক বিক্ষোভের সঙ্গে থাকবে। বিভিন্ন অংশের মানুষ ও সংগঠনকে নিয়ে ২৫ তারিখ ধর্মতলা থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত মিছিলের ডাক দিয়েছে শ্রমিক সংগঠনগুলি। এছাড়াও তাঁরা নিজেরাও বড়সড় আন্দোলের পরিকল্পনা করছে বলে সুত্রের খবর।
এই ইস্যুতে পথে নামার ঘোষণা করে দিয়েছে তৃণমূলও। তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই কৃষি বিলকে গণতন্ত্র-হত্যা’র সর্বাত্মক বলে অভিহিত করে প্রতিবাদের ডাক দিয়েছেন। তৃণমূল কিসান কংগ্রেস সারা রাজ্যে এই দিনটি উপলক্ষে তাদের প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করবে বলে রাজ্য সভাপতি বেচারাম মান্না সূত্রে জানা গিয়েছে। ২৫শে সেপ্টেম্বর সারা দেশ জুড়ে কৃষকদের এই সম্মিলিত বিক্ষোভ কেন্দ্রের বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।