পুরাণের পাতা থেকে সৃজনশীলতা, সামাজিক মাধ্যমে হরেক সাজে জামাইষষ্ঠী—
HnExpress অশোক সেনগুপ্ত, কলকাতা ঃ আয়োজনের যৌক্তিকতা নিয়ে বিতর্ক তো থাকতেই পারে। তবু সকাল থেকে শঙ্খ আর উলুধ্বণি মনে করিয়ে দেয় আর পাঁচটা দিনের চেয়ে এ দিনটা একটু অন্যরকম। তার প্রকাশ হয়েছে সামাজিক মাধ্যমেও। পুরাণকাহিনী, ব্যঙ্গচিত্র, ছড়া, ছবি— সৃজনশীলতায় ভরে উঠল আজকের জামাইষষ্ঠী।
সকালেই জামাইষষ্ঠীকে স্মরণ করেছেন ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের প্রাক্তন রাজ্যপাল তথাগত রায়।
জামাইষষ্ঠীতে তাঁর আক্ষেপের কথা লিখে জানিয়েছেন টুইটে। লিখেছেন, “আজ জামাই-ষষ্ঠীও, যখন বাঙালি হিন্দুরা তাদের জামাইদের ভালমন্দ খাইয়ে আনন্দ করে।
হায়রে আমার শ্বাশুড়ি আর নেই। এবং আমার জামাইরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। দীর্ঘশ্বাস …..।”
“আম কাঁঠাল গন্ধে ভরা জষ্টি মাসে ইলিস ভাপা, চিংড়ি মালাই সঙ্গে আছে, বন্ধ থাকুক আজকে তোমার সকল কাজ, ষষ্ঠীতে তুমি হবে জামাই রাজ …”। এই ছড়া এবং ‘মৌমি র আঁকা’ এই জামাই উৎসব চিত্র-সহকারে রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী, আবৃত্তিকার স্বাতী ভট্টাচার্য ফেসবুকে উপহার দিয়েছেন সংগৃহীত তথ্য— “ষষ্ঠী দেবীর পার্বন থেকে এই প্রথার উদ্ভব।
ষষ্ঠী পুজোর ব্রতীরা সকালে স্নান করে উপবাস থেকে নতুন পাখার ওপর আম্রপল্লব, আমসহ পাঁচফল, আর ১০৮ টি দুর্বাবাঁধা আঁটি দিয়ে পুজোর উপকরণের সঙ্গে রাখে। করমচা সহ পাঁচ, সাত, বা নয় রকমের ফল কেটে কাঁঠাল পাতার ওপর সাজিয়ে রাখা হয়। ধানে পুজোর সমৃদ্ধির প্রতীক আর দুর্বা চিরসবুজ, চিরসতেজ অসীমতার প্রতীক অর্থে ব্যবহৃত হয়। সকল সন্তানকে ধানদুর্বা উলুধ্বনিসহ ষাট ষাট বলে বরণ করি আমরা।“
অভিনেত্রী চৈতালী দাশগুপ্ত যামিনী রায়ের আঁকা ‘পর্বত হিমালয়ের জামাই বাবাজীবন’-সহ লিখেছেন, “আমার আবার ভারত বাংলাদেশ মিলিয়ে অনেক জামাই। আমার দিদাকে দেখেছি করমচা গাছের গুচ্ছ দিয়ে জামাই আশীর্বাদ করতে, কত না প্রথা! আমার জামাইদের মধ্যে বড়টি ড্যাং ড্যাং করে চলে গেলেন সাত তাড়াতাড়ি, কি জানি, সাঁইজির ডাক পেয়েছিল কিনা! আর সব বাবাজীবনদের জন্য মঙ্গল কামনা রইল। সঙ্গের ছবিটি যামিনী রায়ের আঁকা পর্বত হিমালয়ের জামাই বাবাজীবন।”
বেলা পৌনে একটায় ৩৮৪, ১৬ ও ৫। অভিনেত্রী পুত্রবধূ বিদীপ্তা চক্রবর্তী লিখেছেন, “তোমার বড় জামাই আমাদের মধ্যেই রয়ে গেছে গানে সুরে মাটির গন্ধে মিশে।“ মানব সম্পদ পরামর্শদাতা মধুমিতা চ্যাটার্জি লিখেছেন, “প্রতিটি অনুষ্ঠানকে, এমনকি বাঙালীর ১২ মাসের ১৩ পার্বণকেও এমনভাবে কথার ব্যঞ্জনায় ভাবের দ্যোতনায় সাজানো যায়! সত্যি কি সুন্দর এ প্রকাশ।“
আবার প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষিকা দেবশ্রী কুন্ডু বসু লিখেছেন, “আপনার প্রত্যেকটি পোস্ট খুব মন ছুঁয়ে যায়। যেখানে কোনো আরম্বরতা নেই, নিজের বিলাসিতা প্রচার নেই। খুব ভালো লাগে, মনে হয় আপনি আমাদের মতই সাধারণ। এটাই আপনার বিশালতা। খুব ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।“
শ্রীনিবাস অধিকারী একটি পোস্টে লিখেছেন, “ছুটি তো হল, কিন্তু অন্তত বাবাজীবনদের কথা ভেবে আজ দিনটার জন্যে লক ডাউনের বিধিনিষেধ শিথিল করা উচিত ছিল।“ অপর একটি পোস্টে উপহার দিয়েছেন ছড়ায়—
“হুঁ হুঁ অনেক জামাই পেতে পারো বাবা,
দোকানি চাকুরে নিদেনপক্ষে এমেলে
কিন্তু আমার মতন জামাই পাবে না খুঁজলেও,
যে অবিবাহিত ও বেচেলে (ব্যাচেলর)।”
লেখিকা সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “প্রচুর বাড়ির বিছানার চাদর আর প্লাস্টিকের টেবিল কাভার দেখতে হবে আজ।“ এক ঘন্টায় ফেসবুক পোস্টে লাইক ও মন্তব্যের সংখ্যা ১৩৯, ৩১। পায়েল বসু লিখেছেন, “আজ জামাইষষ্টি, মেঘলা ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি মুখর আবহাওয়া। আমার কোন কোন বন্ধু, ভাই আজ শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে ……জানাতে ভুলে যেও না আমাকে!”
সঙ্ঘমিত্রা গাঙ্গুলি একটি ছবি দিয়ে লিখেছেন, জামাইষষ্টির দিনে বাইরে প্রচুর বৃষ্টি। “শ্বশুর— আজ বোধহয় জামাই আসবেন না। লে জামাই।“ ছবিতে সাঁতার কাটছেন বিজেপি-র দিলীপ ঘোষ।
বইপোকার কলম গ্রুপে সোমাশ্রী পাল চন্দ তো ‘জামাই আদর’ নামে একটি ছোটগল্প উপহার দিয়েছেন ফেসবুক বন্ধুদের। রুমা টক্রবর্তীর পোস্ট করা ছবিতে একমুখ হাসি নিয়ে খোপাবাঁধা একটি বাচ্চা ছেলে যাচ্ছে জামাই ষষ্ঠীতে। পরনে কুচি দেওয়া ধুতি আর পাঞ্জাবী। এক হাতে মাছ, অন্য হাতে মিষ্টির হাঁড়ি। পাশে পোষা বিড়াল।
রামধনু গ্রুপে তপন চক্রবর্তী জামাই ষষ্ঠীর উদ্ভব ও বিবর্তনের বিশদ কাহিনী লিখেছেন— “কলকাতার মল্লিকবাড়িতেও জামাইষষ্ঠীর প্রীতিভোজে মাংস নেই। তার বদলে থাকে তপসে, পাকা পোনা, চিংড়ির অবাধ গতি। শেষ পাতে বা বৈকালিক আহারে সরের ক্ষীরের যোগ্য সঙ্গত দেয় আম, লিচু ও তালশাঁস। নিশ্ছিদ্র নজরদারি থাকে বাসনপত্রের খুঁটিনাটির দিকেও।
ইটালিয়ান মার্বেলের বাসনে খাওয়ার পর পিতলের গাড়ুর জলে গামলায় মুখ ধুয়ে, রুপোর কৌটো থেকে লবঙ্গ বেঁধা পান মুখে দিয়ে তবেই জামাইয়ের ক্ষণিক রেহাই। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবারে জামাইষষ্ঠীর ঘটা তো প্রায় কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছেছে। আর আদর-আপ্যায়নের পাশাপাশি জামাইদের বরণ করা হত মহার্ঘ্য উপঢৌকনে। আড়ম্বরে কম যেতেন না সেইসব জামাইরাও।
এই পরিবারের এক কর্তা ক্ষিতীশচন্দ্রের মেয়ে অন্নপূর্ণার স্বামী হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বৈঁচির রাজা। নানা মশলা দিয়ে সাজা পান ঘন ঘন মুখে না পুরলে তাঁর চলত না। তাঁর জন্য সাজা পানের খিলি গাঁথা থাকত সোনার লবঙ্গ দিয়ে। প্রত্যেক বার খাওয়ার আগে সেই সোনার লবঙ্গ তিনি ছুড়ে ফেলতেন। এদিক ওদিকে পড়ে থাকা সেই সোনার লবঙ্গ কুড়িয়ে নিত রাজবাড়ি খুদে সদস্যরা।“
অন্যদিকে এই নিয়েই সাংবাদিক মার্থা ইন্দ্রানী সেনগুপ্ত প্রশ্ন তুলেছেন, “আজ তো বৌমা ষষ্ঠীও করা যেত। যদি জামাই ষষ্ঠী নিয়মের মধ্যে পড়ে, তাহলে বৌমা ষষ্ঠী হবে নয় কেন? “রবীন্দ্র ভারতীর এক প্রাক্তনী লিখেছেন, “আজ জামাই দিবস। প্রচন্ড গরমে হাসফাস অবস্থা, তবু এরই মধ্যে চেপে ধরে বসিয়ে জামাইদের মুখে গুঁজে দেওয়া হয় হরেক পদ। আগেকার দিনে শাশুড়ি বা ছোট শালা-শালি পাখার বাতাস করত খাওয়ার সময়ে।
শাশুড়ি বলতেন বাবা আর দুটো দিই? জামাই কপাল, বগলের, গলার ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে আসা ঘাম মুছে বলত ‘না না, থাক মা, আর দেবেন না’। জামাইদের এই আদর কিন্তু সদ্য বিয়ে করা থেকে পাকাচুল মাথা ইস্তক চলে অথবা শাশুড়ির রান্না করার শারীরিক ক্ষমতা যতদিন থাকে, এখন অবশ্য হরেক রেস্টুরেন্ট আছেই। তাই নো চিন্তা, অনলি খেটন। তবে
এই আনন্দ ভরা সংসারে জামাইদের জন্যও আলাদা দিন আছে, আছে অলটাইম খাতির। কিন্তু বেচারা বউরা কুড়িয়ে বাড়িয়ে যে ক’আনা পায় তাই দিয়ে কাজ চালিয়ে দেয়, তাদের জন্য নো মিষ্টি গুড়, ওনলি মুগুর।”