মুখ থুবড়ে পড়লো বিজেপি, ভবানীপুরে মমতা ব্যানার্জি সহ বাকি তিন কেন্দ্রেই জয় তৃণমূল কংগ্রেসের
HnExpress অরুন কুমার, কলকাতা ঃ পশ্চিমবঙ্গের তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফলাফল গণনা কেন্দ্রে সকাল থেকেই উত্তেজনার পারদ ছিল চরমে। তখনও পর্যন্ত ভবানীপুরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সহ সামসেরগঞ্জ, জঙ্গিপুর সব কেন্দ্রেই তৃণমূল এগিয়ে। বেলা বাড়তে থাকা সঙ্গে সঙ্গে চিত্রটা ক্রমশ আরও পরিষ্কার হতে থাকে। অধিকাংশ পার্টি অফিস ফাঁকা হতে আরম্ভ করে। বিজেপি নেতাদের মোবাইল ফোনের সুইচ অব্দি বন্ধ হয়ে যায়।
তবে নিয়ম রক্ষার খাতিরে কয়েকজন নেতা অবশ্য তাদের মোবাইল অন রেখেছেন, কিছুটা হোমওয়ার্ক করে। এদিকে কমিশন সূত্রের খবর, ভবানিপুর উপনির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জি। ফলত নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ এর মুখ্যমন্ত্রী থাকতে হলে মমতা ব্যানার্জিকে জিততেই হতো এই উপনির্বাচন। আর এই নির্বাচনে অসামান্য সাফ্যলের সাথে জয় পেলেন তিনি। এর আগে মে মাসে বিধানসভা নির্বাচনে জিতে তাঁর দল রাজ্যে ক্ষমতায় এলেও মমতা নিজে বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হতে পারেননি।
দল বিপুল ভোটে জয়লাভ করার পর ৫ই মে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন তৃণমূলনেত্রী। তবে শপথের মেয়াদ ৪ঠা নভেম্বর শেষ হওয়ার কথা ছিল নিয়মানুযায়ী। আর তার আগেই উপনির্বাচনের দিন ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। এবারের উপনির্বাচনে নিজের পুরনো কেন্দ্র ভবানিপুরেই প্রার্থী হন মমতা। আর তাঁর বিরুদ্ধে বিজেপি প্রার্থী ছিলেন প্রিয়াঙ্কা টিব্রেয়াল এবং সিপিএম প্রার্থী শ্রীজীব বিশ্বাস। ৩০শে সেপ্টেম্বর ভোট হয়। ভোট গণনার পরে তার ফল প্রকাশ হয় গত ৩রা অক্টোবর।
৫৮ হাজার ৮৩২ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন মমতা। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, গত ৭ই এপ্রিল সপ্তম দফায় ভোট হয় ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রে। তৃণমূল প্রার্থী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় ২৮ হাজার ৭১৯ ভোটে হারান বিজেপি প্রার্থী রুদ্রনীল ঘোষকে। ৫ মাসের মধ্যে সেই ভবানীপুরেই হলো উপনির্বাচন। ভোটের ফলাফলে তৃণমূল সরকারের ওপর কোনও প্রভাব না পড়লেও, মুখ্যমন্ত্রিত্বের দিক থেকে এই ভোটের ফল যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
উপনির্বাচনে জেতা আসনেও জয় পাওয়া যে কঠিন, সে অভিজ্ঞতা রয়েছে বিজেপি-র। ২০১৯ সালে স্বয়ং দিলীপ ঘোষের ছাড়া খড়্গপুর সদর তৃণমূলের কাছে গো-হারা হারতে হয়েছিল গেরুয়া শিবিরকে। আর ভবানীপুরে গত বিধানসভা নির্বাচনে তো বড় ব্যবধানে জিতেছে তৃণমূল। তার উপর এই উপনির্বাচনে আবারও প্রার্থী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই। ভোট পরার হার সন্তোষজনক নয়। তাই জেতার আশা নয়, বরং কত ভোটের ব্যবধানে পরাজয় তার অঙ্কই কষছিল বিজেপি শিবির।
অপরদিকে ভবানীপুরের সঙ্গে নির্বাচনের ফল ঘোষণা হতে চলা শামসেরগঞ্জ কিংবা জঙ্গিপুর নিয়েও দল আশাবাদী নয়। কারণ মুর্শিদাবাদে না আছে জোরালো সংগঠন, না ছিল জেতার হাওয়া। ফলে রবিবারের ফল যে ৩-০ হতে চলেছে তার জন্য অন্তত মানসিক ভাবে প্রস্তুতই ছিল বিজেপি। আর মমতার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রিয়ঙ্কা টিবরেওয়াল প্রচার পর্বে নিজেকে ‘লড়াকু’ নেত্রী হিসেবে তুলে ধরলেও ফল ঘোষণার দিন তিনি তুলনামূলক ভাবে ছিলেন একেবারে নিশ্চুপ।
এদিন সংবাদ মাধ্যমের কাছে তিনি জানান, ‘‘আমি ফল নিয়ে ভাবছি না। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এখন অন্য কাজে ব্যস্ত রয়েছি।’’ কিন্তু প্রিয়ঙ্কা ‘অন্য কাজ’-এ ব্যস্ত থাকলেও বিজেপি শিবিরের একাংশ হিসেব কষে ফেলেছেন পরাজয়ের ব্যবধান নিয়ে। রাজ্য নেতাদের প্রায় সকলেই মনে করছেন বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় উপনির্বাচনে জয়ের ব্যবধান বাড়িয়ে নেবে তৃণমূল, আর বাস্তবে হয়েছেও সেটাই হল। এরপর অবশেষে ভবানীপুরে রেকর্ড ভোটে জয়ী হলেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভবানীপুরে ৫৮ হাজার ৮৩২ ভোটে জিতেছেন তিনি, একেবারে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অভিমত, ভোট প্রচারে যাই বলা হোক না কেন ভবানীপুর যে দলের জন্য কঠিন ঠাঁই, তা মেনে নিচ্ছেন রাজ্য নেতারা। এক শীর্ষ নেতার বক্তব্য, ‘‘আসলে উপনির্বাচন যখন রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় কোনও পরিবর্তন আনতে পারবে না বলে বোঝা যায়, তখন সাধারণ ভোটাররা চিন্তা কম করেন। এমন কী ভোট দিতেও সে ভাবে আগ্রহ দেখান না। সেটা পরিসংখ্যানই বলে দেয়।’’ আর এই বক্তব্য যে অনেকাংশেই ঠিক, তার উদাহরণ আগেই দেখিয়েছে ভবানীপুর। ২০১১ সালেও এই আসনে উপনির্বাচনে জিতেছিলেন মমতা।
সে বার নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী সুব্রত বক্সী যখন জিতেছিলেন, তখন এই আসনে ভোট পড়েছিল ১,৩৫,৭৪১টি। যা মোট ভোটারের ৬৩.৭৮%। পরে মুখ্যমন্ত্রী যখন উপনির্বাচনে প্রার্থী হলেন, তখন সেটা কমে হয়ে যায় ৯৫,০৬৪ অর্থাৎ ৪৪.৭৩ শতাংশ। মানে ১৯.০৪ শতাংশ কম। আবার ২০১৬ সালে মমতা যখন জিতলেন তখন ভোট পড়ে ১,৩৭,৪৭৫। মোট ভোটারের ৬৬.৮৩ শতাংশ। গত এপ্রিল মাসে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় যখন জিতলেন, তখন ভোট পড়েছিল ১,২৭,৫৩৬। মানে ৬১.৭৯ শতাংশ। আর এ বার পড়েছে ৫৭ শতাংশের একটু বেশি।
এদিকে উপনির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর
বিজেপি নেতারা মুখে না বললেও একান্ত আলোচনায় স্বীকার করেছেন, প্রচারে উত্তাপ ছড়ানো গেলেও ভবানীপুরে ভোট করাতে পারেনি দল। বহুতলের বাংলাভাষী নন এমন বাসিন্দাদের ভোটের লাইনে দাঁড় করিয়ে জয় পেতে চেয়েছিল বিজেপি। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা।
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ‘পরিবর্তনের’ নির্বাচনে মমতা লড়েননি৷ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি এই ভবানীপুরের উপনির্বাচনে লড়েন৷ সেবার তিনি ভোট পেয়েছিলেন ৭৩ হাজার ৬৩৫৷
ভোটের ব্যবধানে ছিল ৫৪ হাজার ২১৩৷ পাঁচ বছর পর ২০১৬ সালে অবশ্য ভোট কমে মমতার৷ সঙ্গে ব্যবধানও কমে৷ সেবার মমতা ভোট পেয়েছিলেন ৬৫ হাজার ৫২০৷ জয়ের ব্যবধান ছিল ২৫ হাজার ৩০১৷ কিন্তু সেই সব ফলকে ছাপিয়ে গেল এবার মমতার বিজয়ী রথ৷ এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০১১ সালে ভবানীপুরে তৃণমূল প্রার্থী ছিলেন সুব্রত বক্সি৷ তিনি সেবার ৪৯ হাজার ৯৩৬ ভোটে জিতে ছিলেন৷ তার কয়েক মাসের মধ্যেই যখন মমতা প্রার্থী হন, তখনও দেখা গেল সেই ব্যবধান অনেকটাই বেড়ে গেছে৷
আর ২০২১ এ-ও আবার তাই হল৷ মে মাসে যখন বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হয়, তখন দেখা গিয়েছিল যে ২৮ হাজার ৭১৯ ভোটে জিতেছেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়৷ আর এবার দেখা গেল, মমতার জয়ের ব্যবধান ৫৮ হাজার ৮৩৫৷ মমতা পেয়েছেন ৮৫ হাজার ২৬৩টি ভোট৷ আর একটু গভীরে গেলে দেখা যাবে, এবারেও ভবানীপুর উপনির্বাচনে নিজের অতীত রেকর্ড ভেঙে বিপুল ভাবে জয়লাভ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল নেত্রীর সামনে দাঁড়াতেই পারেননি বিজেপি প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিব্রেয়াল।
শুধু তাই নয়, এবারে এই বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে প্রতিটি ওয়ার্ডে জয়লাভ করেছে তৃণমূল। এর আগে যখন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় লড়ে ছিলেন, তখন এই বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে দুটি ওয়ার্ডে পিছিয়ে ছিল তৃণমূল। কিন্তু এবারে বিজেপির এগিয়ে থাকা ওয়ার্ডেও লিড ছিনিয়ে নিয়েছে তৃণমূল। সূত্রের খবর, হার নিশ্চিত জেনেও রবিবার কী বলা হবে, তার মহড়াও করে রেখেছিল বিজেপি। ভোট গ্রহণের দিন থেকেই গেরুয়া শিবির অপপ্রচার শুরু করে যে, মুখ্যমন্ত্রীর জয় নিশ্চিত করতে কারচুপির আশ্রয় নিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস।
অন্য দিকে, শাসকদল জয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে স্লোগান তুলেছে, ”Be for Bhavanipur, Be for Bharat।” এর পাল্টা দিতে এক বিজেপি নেতা বললেন, ‘‘তৃণমূল যদি ওটা বলে তো আমরাও ঠিক করে রেখেছি কী বলব। আমাদের স্লোগান হবে, ”Be for Bhabanipur, Be for Banshdroni। কারণ, ভবানীপুরে আমরা যে হাতেনাতে বাঁশদ্রোণী থেকে আসা সব ভুয়ো ভোটাদেরকে ধরেছি।’’ আর এসব নিয়েই যে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল এখন ব্যস্ত থাকবে এ বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ২০১১ তে ভবানীপুরের উপনির্বাচন ও এবারের ভোটের প্রেক্ষিত অনেকটাই এক৷ কারণ, সে বার বাম জমানা শেষ করতে চেয়ে ভোটের লড়াইয়ে নেমেছিলেন মমতা৷ রাজ্যের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর উপরই ভরসা করেছিল আম জনতা৷ এবারও তাই হয়েছে বলে মতামত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের৷ তাঁরা বলছেন যে, এবার বিধানসভা নির্বাচনে মমতা হয়তো হেরেছেন, কিন্তু ২১৩টি আসনে তাঁর উপর ভরসা করেই বাংলার ভোটাররা ঘাসফুলে ভোট দিয়েছেন ৷ তাই তাঁকেই মুখ্যমন্ত্রী রাখতে হবে, সেই বার্তাই ভবানীপুরের মানুষ গোটা বাংলাকে দিল বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।