December 10, 2024

সিংহাসনের মহাসংগ্রাম, মসনদ কার হবে তা নিয়ে চলছে চায়ের চুমুকে জোর জল্পনা

0
West Bengal Elections.jpg
Advertisements

HnExpress পল মৈত্র, দক্ষিন দিনাজপুর ঃ রাজ্যে ৭ দফার লোকসভা নির্বাচনের দিন নির্ঘণ্ট ইতোমধ্যেই ঘোষনা হয়েছে আর সেই নির্বাচনকে পাখির চোখ করে বাম-ডান, বিজেপি সিংহাসনের মহাসংগ্রামের জন্য ভোট প্রচারের ময়দানে নেমে পড়েছেন সকলে। আর এই ভোট নিয়ে চায়ের দোকান, বাসস্ট্যান্ড থেকে শুরু করে জেলার মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে ভোটের আলোচনা। কার হবে সিংহাসন? কে বসবে মসনদে। আলোচনার একদিকে আসছে বিগত ছয় বছরে শাসক দলের করা উন্নয়নের প্রসঙ্গ, তেমনই আছে বিজেপি নিয়ে তরজা। সবার মুখে একই কথা এবারের নির্বাচন তৃণমূল ভার্সেস বিজেপি। অন্যদিকে আলোচনায় আসছে বিজেপি’র প্রসঙ্গ। বিগত লোকসভা নির্বাচনে মোদী হাওয়ায় ভর করে গেরুয়া ঝড় ওঠে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিলো বিজেপি। এই লোকসভা নির্বাচনে গেরুয়া ঝড়ের সেই ধারা বজায় রাখতে পারে কি না এখন সেটাই দেখার বিষয়।

দক্ষিন দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুরের কাকার চায়ের দোকানের মালিক নির্মল সরকার প্রায় ২৫ বছর ধরে এই চায়ের দোকান চালাচ্ছেন। তিনি জানান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে ‘চায়ে পে চর্চা’ নাম দিয়ে প্রচার শুরু করেছিলেন। কিন্তু রাজ্যের মানুষরা অনেক আগে থেকেই চায়ের ভাঁড়ের সঙ্গে রাজনৈতিক চর্চার বিষয়টিকে জড়িয়ে নিয়েছেন। এজন্য কাকার চায়ের দোকান সেই ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে।
তিনি আরো জানান, দোকানে বসে নিরপেক্ষ থাকাই ভালো। তবে দোকানে বসে থাকা সব খরিদ্দারকে তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে চান তিনি। অবশ্য বিতর্ক যখন মাত্রা ছাড়ায় তখন গরম চা পরিবেশন করে তিনি পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করেন।

ওই চায়ের দোকানে বসে আলোচনা করছিলেন সমীর সাহা। তিন বছর আগে তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনি জানান, গত বিধানসভা নির্বাচনের সঙ্গে পরিস্থিতির আকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে এই লোকসভা নির্বাচনের। ২০১৪ সালে কংগ্রেস সরকারকে সরিয়ে দেওয়ার পর যে গেরুয়া ঝড়ের হাওয়া তৈরি হয়েছিল সেই হাওয়ায় ভর দিয়ে ভোটে জয়ী হয়েছিলো বিজেপি। কিন্তু এই বছর তাদের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে আমাদের রাজ্যে, কারন গত ছয় বছরে বর্তমানের শাসক দলের উন্নয়নের নিরিখে মানুষ কতটা কাকে নেবে সেটাই দেখার। এক কলেজ ছাত্র সৌরভ বসাক বলেন, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে দুর্নীতি একটা বড় ইস্যু। দুর্নীতি ইস্যু বিগত লোকসভা নির্বাচনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলো। ঠিক তেমনই ২০১৬ সালের পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে দুর্নীতি অন্যতম বড় ইস্যু। একই সঙ্গে তিনি তুলে আনেন নারদ-সারদা কেলেঙ্কারি। চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিচ্ছিলেন শ্যামলাল আগারওয়াল। বাঙালি না হলেও পাঁচ দশক ধরে জেলায় তিনি। বর্তমানে তিনি জেলার একজন স্থায়ী বাসিন্দা ও ভোটার। তিনি জানান, কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের কাজকর্মের প্রভাব পড়বে ভোটে, ভালো ফল করতে পারে বিজেপি। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম চেহারা একই। জেলার আরো এক বিখ্যাত সুশান্তের চায়ের দোকান যা গঙ্গারামপুর নাট্য সংসদের কাছে অবস্থিত। এখানে নির্বাচনে লড়াই করছেন তৃণমূলের অর্পিতা ঘোষ, বামফ্রন্ট থেকে রনেন বর্মন, কংগ্রেস থেকে সাদেক সরকার কিন্তু বিজেপি এখনো প্রার্থী না দেওয়ায় জেলা জুড়ে চলছে জল্পনা ও সমালোচনা। এই দোকানের একটি বিশেষত্ব আছে। দোকানে পাতা চার পাঁচটি কাঠের বেঞ্চ, বেঞ্চগুলোও তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীদের দখলে থাকে দিনের বেশির ভাগ সময়টা।

হারুর কাছে এবারের ভোটের ইস্যু কি জানতে চাইলে তিনি আঙুল দেখিয়ে দিলো বেঞ্চে বসে থাকা কয়েকজনের দিকে। চায়ের দোকানে চার-পাঁচটি বেঞ্চ থাকা বর্তমানে এক বিরল দৃশ্য। রাস্তার পাশের চায়ের দোকানগুলিতে সাধারণত কোনো বসার জায়গা থাকে না। যেগুলিতে থাকে সেগুলিতে একটির বেশি বেঞ্চ দেখা যায় না। হারুর দোকানে বসার জায়গা থাকায় আড্ডাও জমে। হারু চায়ের পিপাসা নিবারণ করতে সদাই ব্যস্ত। হারুর দোকানে বসে থাকা তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী ভিকি সাহা জানান, রাজ্যের দিকে তাকালেই বোঝা যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ও উন্নয়নের ছটায় কতটা পরিবর্তন হয়েছে। কলকাতাকে লন্ডন করার স্বপ্ন দেখেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, লন্ডন কি হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরে ভিকি বলেন, মাত্র ছয় বছর সময়ে কলকাতা সহ সারা রাজ্যকে যেভাবে সাজানো হয়েছে সেটা প্রতিটি মানুষের চোখে দেখতে পাচ্ছেন। তাছাড়াও গ্রামের মানুষের অনেকটা উন্নতি হয়েছে তৃণমূল সরকারের আমলে।
এ সময় ভিকির বক্তব্যের বিরোধিতা করে বিপ্লব পাল জানান, কলকাতার উড়াল সেতু ভেঙে পড়া, মহিলাদের ওপর অত্যাচারের ঘটনা বৃদ্ধি, আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনার সঙ্গে শাসক দলের নেতাদের নাম জড়িয়ে যাওয়া জনমানসে প্রভাব ফেলবে।

ভোটে কি বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের জোট ‘ফ্যাক্টর’ হলোনা এই কথায় চা খেতে আসা বিপুল রায় জানান, জোট একটা বড় ‘ফ্যাক্টর’ ছিল তার কারণ বিরোধী ভোট এক জায়গায় আসলে শাসক দল সমস্যায় পড়বে। তবে সেটা সরকার পরিবর্তনে কতটা সহায়তা করবে সেটা নিয়ে তিনি সন্দিহান। জেলার গঙ্গারামপুর বাস টার্মিনাস মালদা-বালুরঘাট ৫১২ নং জাতীয় সড়কের পাশে হওয়ার এখানে পাওয়া গেল বেশ কিছু চায়ের দোকান আছে যার ফলে দোকানে প্রচুর মানুষ ভিড় জমান। বাড়ি ফেরার পথে বা কাজের ফাঁকে এসে একটু চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দেওয়া। সেই চায়ে চুমুকের ফাঁকেই রাজীব সাহা জানান, শহরের বেশ কিছু উন্নতি হয়েছে একথা ঠিক, কিন্তু শিল্প ক্ষেত্রে সেই ধরণের কোনো উন্নতি তার চোখে পড়েনি। তার মতে বড় শিল্প রাজ্যে আসেনি। এর ফলে কাজের বাজারে চাপ বেড়েছে। তবে বড় শিল্প না আসলেও ক্ষুদ্র শিল্পে রাজ্য অনেকটাই উন্নতি করেছে বলে মনে করেন আরেক কর্মী বাসু ঘোষ। তবে তিনি চিন্তিত মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে। বিগত কয়েক বছরে ঘটে যাওয়া নারী নির্যাতনের ঘটনা তাকে যথেষ্ট নাড়া দিয়েছে।

কি হতে পারে ভোটের ফলাফল? কে বসবে মসনদে? এই প্রশ্নের উত্তরে রাজা সরকার জানান, জোট একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘ফ্যাক্টর’ ছিল বিরোধীদলের ভোট এক জায়গায় পড়লে সমস্যায় পড়বে শাসক দল। তবে এই তত্ত্বকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিলেন ইমানুল হক। তার বক্তব্য বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের একে অপরের বিরোধী হিসেবে শুধু একটি প্রজন্ম নয় একাধিক প্রজন্মের লড়াইয়ের ইতিহাস আছে। তাছাড়া কেরালা রাজ্যে বাম এবং কংগ্রেস মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে লড়াই করছেন। সেক্ষেত্রে নেতারা জোট করেও পিছিয়ে গেলেন নিচু তলার কর্মীরা এই জোটে না হওয়ায় কতটা খুশি সেটা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ থেকেই যায়। আর এই প্রশ্নই ভোটের ফলাফলের আগাম ইঙ্গিত
খুঁজতে সব থেকে বড় বাধা। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে চায়ের সঙ্গে কখনও উঠে এলো তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত মা মাটি মানুষ সরকারের ভালো কাজের খতিয়ান, কখনও সমালোচনা। ঠিক তেমনই উঠে এলো বামফ্রন্ট -কংগ্রেসের জোট না হওয়ার নেতিবাচক দিকের সঙ্গে কিছু প্রশ্নও। এই প্রশ্ন এবং উত্তর চলতেই থাকবে, ঝড় উঠতে থাকবে চায়ের কাপে। আর নির্বাচন শেষ হবে, নতুন সরকার গঠন হবে কিন্তু জেলার এইসব চায়ের দোকান গুলিতে সময় করে আড্ডা ,গল্প, আলোচনা চলবেই। সময়ের চাহিদা মেনে সঙ্কুচিত হতেই পারে এইসব দোকানের পরিসর, কমতে পারে কাঠের বেঞ্চের সংখ্যা। কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলা চায়ের দোকানের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক কোনো ভাবেই শেষ হবে না । সেকথা ভরসা করে বলাই বাহুল্য। সর্বশেষে, এই লোকসভা নির্বাচনে সিংহাসনের মহাসংগ্রামে কার হবে মসনদ সেই ফলাফলের অপেক্ষায় সময়ের প্রহর গুনছে রাজ্যের মানুষ সহ দেশবাসী।

Advertisements

Leave a Reply