বরানগর পুরসভায় কর্মী নিয়োগে দুর্ণীতি; সরব বামেরা
HnExpress ২৯শে জুলাই, ঝুম্পা দেবনাথ, বরানগর ঃ এবছর উওর ২৪ পরগনা জেলার বরানগর পুরসভায় ২৯০ জন তরুণ-তরুণীকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ করা হয়েছে। ২০১৮ সালে এই নিয়োগ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল এবং ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে হয় এই কর্মী নিয়োগের ইন্টারভিউ। কিন্তু এবছর এই পুরকর্মী নিয়োগকে ঘিরে অস্বচ্ছতার প্রশ্ন তুলে বরানগর পুরসভার ২জন অস্থায়ী কর্মী হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। বরানগর পুরসভায় এই কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে সরব বামেরা। তাদের পক্ষ থেকে উঠে আসছে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য।
দমদম পুরসভার বিধায়ক তথা বাম দলীয় নেতা তন্ময় ভট্টাচার্য বললেন, বরানগর পুরসভায় স্বজনপোষণ ও দুর্ণীতির ভিত্তিতে কর্মী নিয়োগ করা হয়েছে। এছাড়াও তিনি জানান, কোটি কোটি টাকার আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে এই কর্মী নিয়োগ করেছেন বরানগর পুরসভার প্রশাসক মন্ডলীবৃন্দ। তিনি কটাক্ষের সুরে প্রশ্ন তুলেছেন, গত বছর এই কর্মী নিয়োগকে ঘিরে অস্বচ্ছতা ধরা পড়লে, পুরমন্ত্রী কর্মী নিয়োগের মেরিট লিস্ট বেরোনোর কথা বলেছিলেন।
কিন্তু এবছরও মেরিট লিস্ট অপ্রকাশিত করেই নিয়োগ করা হল, পুরমন্ত্রীর বিধানসভায় দেওয়া বিবৃতি কেন বাস্তবায়িত করা হল না ? তিনি আরও জানান, ২৯০ জন কর্মী নিয়োগের মধ্যে ১৭৫ জন কর্মীকে নিয়োগ পত্র দেওয়া হয়েছে, বাকিদের নিয়োগপত্র দেওয়া হয়নি এবং মজদুর পদে নিয়োগ কর্মীদের অফিসে কাজ করানো হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এই ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতিতে বাজারে জিনিসপত্রের দাম যেখানে অগ্নিমূল্য, সেখানে সদ্য নিয়োগ হওয়া কর্মীদের বেতন দেওয়া হয়নি, শুধু মাত্র অগ্ৰিম দেওয়া হয়েছে।
সেই সঙ্গে তিনি যে সকল তরুণ-তরুণী কর্মী হিসাবে নিয়োগ হয়েছেন তাদের সকলকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, সদ্য নিয়োগ হওয়া কর্মীদের নিয়ে কোন মন্তব্য নেই, কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ এটা মানতেই হবে। এর পাশাপাশি স্বজনপোষণ মন্তব্যের ভিত্তিতে যথোপযুক্ত তালিকা প্রকাশ্যে তুলে ধরেন দমদম পুরসভার বিধায়ক তথা বাম দলীয় নেতা তন্ময় ভট্টাচার্য। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও জানান, সেই তালিকায় উঠে এসেছে কয়েকজন কাউন্সিলর ও চেয়ারম্যানের আত্মীয়-স্বজনের নাম।
তাদের মধ্যে অন্যতম হল; কামারহাটি পুরসভার চেয়ারম্যানের ভাইপো, উওর দমদম পুরসভার চেয়ারম্যানের মেয়ে, তৃণমূল ট্রেড.ইউনিয়নের রাজ্য নেতার ছেলে, বরানগর পুরসভার প্রাক্তন কাউন্সিলর তথা প্রশাসকমন্ডলীর অন্যতম প্রশাসক আল্পনা নাহার ছেলে, বরানগর পুরসভার প্রাক্তন কাউন্সিলর রীতা (বিউটি) মুখার্জীর ছেলে, বরানগর পুরসভার প্রাক্তন কাউন্সিলর অনিন্দ চৌধুরীর ছেলে, বরানগর পুরসভার প্রাক্তন কাউন্সিলর গীতা দেবী গুপ্তার নাতনি, বরানগর পুরসভার প্রাক্তন কাউন্সিলর সুনাথ বিশ্বাসের ভাইপো।
এছাড়াও বরানগর পুরসভার প্রাক্তন কাউন্সিলর সুবীর চৌধুরীর ভাইপো, বরানগর পুরসভার প্রাক্তন কাউন্সিলর তথা প্রশাসকমন্ডলীর অন্যতম প্রশাসক অমর পালের ভাইপো, বরানগর পুরসভার প্রাক্তন কাউন্সিলর বীনা দাস জানার বোনঝি। স্বজনপোষণের ভিত্তিতে এই নিয়োগ, এমনটাই দাবি করছেন দমদম পুরসভার বিধায়ক তথা বাম দলীয় নেতা তন্ময় ভট্টাচার্য। বরানগর পুরসভার প্রাক্তন কাউন্সিলর তথা বাম দলীয় সদস্য স্বাতী দাস জানান, এই বছর পুরসভায় কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়াক সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ ও স্বজনপোষণ ছিল।
নিয়োগ প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়া বোর্ডে উপস্থিত ছিলেন পরীক্ষার্থীর আত্মীয়রাই, স্বভাবতই স্বজনপোষণের ভিত্তিতে নিয়োগ হয়েছে বলেই দাবি করছেন তিনি। আর এরই পাশাপাশি তিনি বলেন, তাঁর কাউন্সিলর জীবনে সম্পূর্ণ সহায়তা পেয়েছিলেন বরানগর পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান তথা প্রশাসক মন্ডলীর প্রধান অর্পনা মৌলিকের কাছ থেকে। কিন্তু যখন কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে অস্বচ্ছতার প্রশ্ন উঠেছে, তখন তিনি সহায়তা করতে পিছু হাঁটছেন।
বরানগর অঞ্চলের সিপিএম-র ১ ও ২ নম্বর কমিটির সদস্য সানু রায় জানান, বরানগর পুরসভার সদ্য নিয়োগ কর্মীর মধ্যে কেউ কেউ প্রভাবশালী কাউন্সিলর বা চেয়ারম্যানের আত্মীয় হতেই পারেন, কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়ার সময় শুধু মাত্র গুরুত্ব পেয়েছেন কাউন্সিলর বা চেয়ারম্যানের আত্মীয়রা, আবার কখনো গুরুত্ব পেয়েছেন বিপুল অঙ্কের টাকা লেনদেন হওয়া তরুণ-তরুণীরাই। পুরভোটের আগে বামেদের এই অভিযোগের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী তথা বরানগর বিধানসভার বিধায়ক তাপস রায় জানান, বিধায়ক হলেই তো আর স্পষ্ট ভাবে নজর দেওয়া যায় না সমস্ত দিকে।
তাই বামেদের অভিযোগের এই সমস্ত উওর দিতে পারেন বরানগর পুরসভার প্রশাসক মন্ডলীরাই। তিনি আরও জানান, এই করোনা পরিস্থিতিতে আগে মানুষকে করোনার মতো মহামারীর কবল থেকে বাঁচানোর চিন্তা করছি সবার আগে, তারপর সময় বুঝে বামেদের এই সমস্ত অভিযোগের দিকে কর্ণপাত করবেন বলেই জানান তিনি। অন্যদিকে বরানগর পুরসভার প্রশাসক মন্ডলীর প্রধান অর্পনা মৌলিক জানান, এই করোনা পরিস্থিতিতে যে ২৯০ জন তরুণ-তরুণীর মুখে অন্নসংস্থানের ব্যাবস্থা করে দিতে পেরেছি, এতে বামেরা ঈষান্বিত হচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, এই কর্মী প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার সহিত হয়েছে৷ বরানগর পুরসভার প্রশাসক মন্ডলীর অন্যতম প্রশাসক জয়ন্ত রায় জানান, বামেদের কার্যকলাপ দুর্ণীতিগ্ৰস্ত এবং আর্থিক কারচুপিপূর্ণ, তাই এই দুর্দিনে পুরসভার স্বচ্ছতার সহিত কর্মী নিয়োগের মধ্যেও দুর্ণীতির গন্ধ পাচ্ছেন বামেরা, এমনটাই জানিয়েছেন তিনি। বরানগর পুরসভার প্রশাসকমন্ডলী অন্যতম দিলীপ নারায়ণ বসু জানান, বামেদের অভিযোগ সম্পূর্ণই ভিত্তিহীন।
তিনি আরও জানান, মেরিট লিস্ট প্রকাশের মাধ্যমে স্বচ্ছতার সঙ্গে নিয়োগ প্রক্রিয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, লকডাউনের দরুন কিছু প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় সদ্য নিযুক্ত কর্মীরা বেতন পারছেন না এটা ঠিকই। কিন্তু চিন্তার কিছু নেই, কিছু দিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে বলেই জানিয়েছেন তিনি। বরানগর পুরসভার প্রশাসক মন্ডলীর আরেক প্রশাসক আল্পনা নাহা জানান, স্বজনপোষণের দৃষ্টিতে নয়, সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার সঙ্গে নিয়োগ প্রক্রিয়া অতিবাহিত হয়েছে, তাই বামেদের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
বরানগর পুরসভার প্রশাসকমন্ডলীর আরেক প্রশাসক অমর পাল জানান, মেরিট লিস্ট প্রকাশের মাধ্যমে স্বচ্ছতা সঙ্গে কর্মী নিয়োগ হয়েছে। তিনি আরও জানান, কিছু কিছু শিক্ষিত তরুণী মজদুরের জন্য আবেদন করেছিলেন, কিন্তু মানবিকতার সহিত সেই সকল শিক্ষিত তরুণীদের দিয়ে মজদুরের পরিবর্তে অফিসে কাজ করা হচ্ছে, এর মধ্যে বামেদের করা অভিযোগের ভিত্তিতে কোন দু্র্ণীতি বা স্বজন পোষণ বা আর্থিক লেনদেন নেই বলে জানান তিনি।
বরানগর অঞ্চলের এক সমাজকর্মী জানান, পুরসভার কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এরকম সম্পূর্ণ অস্বচ্ছতার ভিত্তিতে খুবই বিব্রত হয়েছেন তিনি। তার পাশাপাশি আরও বলেন, পুরসভার পৌরপিতা ও পৌরমাতারাই যদি এই ভাবে দুর্ণীতিকে আলিঙ্গন করেন, তাহলে ভবিষ্যতে সঠিক পথের দিশা দেখাবেন কারা? আগত ভোটের ফলাফলই কি তার উওর দেবে? এমনটাই মতামত তাঁর।