বিশেষ নিবন্ধ : গভীর সংশয়ে স্মৃতির এক গ্রন্থাগার
HnExpress সম্রাট গুপ্ত, কলকাতা : ওঁরা খুঁজে বেড়াচ্ছেন বইপ্রেমিকদের। ওঁরা মানে, কসবার একটা বিশেষ অঞ্চলের কিছু অবসরপ্রাপ্ত বাসিন্দা। সাজানো গোছানো গ্রন্থাগার হয়েছে। পাঠক নেই। খোঁজ পেলেই অনুরোধ করছেন, “আসুন না। সদস্য হোন গ্রন্থাগারের।”
রথীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগেজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে। ইহারা সহসা যদি বিদ্রোহী হইয়া উঠে, নিস্তব্ধতা ভাঙিয়া ফেলে, অক্ষরের বেড়া দগ্ধ করিয়া একেবারে বাহির হইয়া আসে! হিমালয়ের মাথার উপরে কঠিন বরফের মধ্যে যেমন কত কত বন্যা বাঁধা আছে, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে মানবহৃদয়ের বন্যা কে বাঁধিয়া রাখিয়াছে!“
সেই রামও নেই, অযোধ্যাও নেই। একসময় গ্রন্থাগারগুলি ছিল রীতিমত ব্যস্ত। পড়ুয়া থেকে গৃহিনী— সবারই আগ্রহ ছিল গ্রন্থাগারের ওপর। সময় আর প্রযুক্তি এসে সব যেন খেয়ে নিয়েছে। একশ-দেড়শ বছরের বেশ কিছু গ্রন্থাগার এখনও টিঁকে আছে এ রাজ্যে। এক সময়কার রাজা-জমিদাররা গ্রন্থাগার তৈরি ও সম্প্রসারণে বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছেন।
দক্ষিণ কলকাতার বি বি চ্যাটার্জি রোডের রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ছিলেন পেশায় নির্মাতা। লক্ষীর সঙ্গে সরস্বতীর আরাধনাও করতেন নিষ্ঠার সঙ্গে। প্রচুর বই ছিল তাঁর সংগ্রহে। ২০১৫-তে মারা যান। বিয়ে করেননি। মারা যান ২০১৫-র ২৭ মার্চ। তার আগেই পাঁচ ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে দায়িত্ব দিয়ে যান বইগুলি দেখভাল করার। ইচ্ছে ছিল, মানুষ বইমুখী হবে। এই পাঁচ বন্ধুর অন্যতম যৈমিনি বর্মণ এই প্রতিবেদককে জানালেন, সপ্তাহে তিন দিন, তিন ঘন্টার জন্য (৪-৭) খুলি এটা। ১২৬, বি বি চ্যাটার্জি স্ট্রিটের পাঁচ তলায় বইগুলি নিয়ে তৈরি হয়েছে এই লাইব্রেরি।
১৮৩৬ সালে এই গোটা তল্লাটে প্রথম আধুনিক গ্রন্থাগার তৈরি হয় ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি। ১৮৯১-তে কয়েকটি সচিবালয়ের গ্রন্থাগার মিলিয়ে তৈরি হল ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি। লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামের জন ম্যাকফারসেন থেকে গভর্নর জেনারেল লর্ড মেটকাফ, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় থেকে ভাষাবিদ হরিনাথ দে— নানা সময়ে এ দেশী, বিদেশী অনেকেই আত্মনিয়োগ করেছেন এ শহরের গ্রন্থাগারের উন্নয়নে। সফলও হয়েছেন। পরিস্থিতি বদলিয়েছে। এখন জীবন মুঠোফোন-নির্ভর।
৭০ জন সদস্যের মধ্যে সাত জনও আসেননা গ্রন্থাগারে। তাহলে, প্রয়াত রবীন্দ্রনাথবাবুর ইচ্ছেপূরণের পথ কী? যামিনীবাবুর জবাব, “এই প্রজন্ম পাঠ্যপুস্তক থাকলে অন্তত কেউ কেউ লাইব্রেরিতে আসবে। আর একটা ঘর, আর কিছু পাঠ্যপুস্তক নিয়ে এর সম্প্রসারণ করা যায় কি না দেখছি।”