এক ট্রেনযাত্রীর কলম!
HnExpress খেয়ালিপনা, দিব্যেন্দু ঘোষ : আমি বিছানায় আড়মোড়া ভাঙলাম| রূপসী হেমন্ত দিগন্তে আলস্য ত্যাগ করল| তবে, আমার জেগে ওঠার বড় প্রয়োজন ছিল না| আসলে রূপমতী ভোর বড় হাতছানি দিচ্ছিল| সর্পিল গতিতে ট্রেনের জানলা বেয়ে ওই দূরে দৃষ্টিপাত কখন জানান দেবে শীত পেরিয়ে বসন্তের আগমনী|
কুয়াশা তখন চুঁইয়ে পড়ছে মেঠো গালিচায়| আসমানি শতরঞ্চিতে খানিক জিরোন দিচ্ছে মিঠে উত্তাপ| সূয্যিমামা চরাচরের কোল ঘেঁষে অধীর অপেক্ষায়| পেয়ারা পাতায় ভিজে ভাব| মাটিতে সোঁদা গন্ধ বড় মন-উচাটনী| কলসি কাঁখে আলগোছ রাস্তায় সারি দিয়ে হাঁটছে আদিবাসী কন্যেরা| গাছকোমর করে বাঁধা শাড়ির খুঁট গোঁজা ঠিক নাভির গা ঘেঁষে|
রাস্তায় তখনও কুণ্ডুলী পাকিয়ে শুয়ে সারমেয়সকল| ওরা এখন চিনে গেছে| চেনা মানুষের গন্ধ ওদের এখন আর বিচলিত করে না| নির্জীব পথের প্রান্তরে ওরাও জিরিয়ে নেওয়ার অবকাশ খুঁজে নেয় ঠিক|
৪.১৪-র হলদিয়া লোকাল| কখন যে ভুলেই গেছিলাম | জোড়াবাড়ির ফোকর দিয়ে চলন্ত সাপের গতি আন্দাজ করা কঠিন| সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিচ্ছি দ্রুত| হাইটেনশন তারের জট ঠিক মাথার ওপর| টেনশন বাড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট| ট্রেন মিস করা চলবে না| ফুট ওভারব্রিজ আর প্ল্যাটফর্মের কিনার ঠিক যেখানটায় মিশে আছে, ওইখানে পা রাখার আগেই ট্রেনের গেটে চোখে পড়ল শর্ট স্কার্ট| দুকাঁধ বেষ্টন করে আছে কালো পিঠ-ব্যাগের জড়িয়ে ধরা হাত| নীচে নিশ্চয়ই আরও একটা কালো স্ট্র্যাপ আছে পড়ে অনাদরে| টপের গোলাপি আভা দূর-দৃষ্টিকে অনধিকার প্রবেশে সাড়া দিচ্ছে না দেখে চোখ নামালাম| তখনই চোখের সামনে উন্মুক্ত নীলচে রোমে আলতো ঢাকা আবেদনের দুই পেলব পাঠশালা| রোদ-বৃষ্টির কানাকানিতে আনকোরা হেমন্তে আমার শরীর-মন যে বসন্তের পুণ্যতায় আচ্ছন্ন হতে চলেছে, তা বুঝলাম| অন্তত চেষ্টা করলাম বোঝার| স্টিলের শক্ত রডে হাত রেখে কামরার পাদানিতে পা রাখতেই একটু সরে গেল শর্ট স্কার্ট|
এটা কি সাঁকরাইল স্টেশন?
কোথায় নামবেন?
পাঁশকুড়া| আপনি?
যেখানে নিয়ে যাবে নিয়তি|
নিয়তি-স্টেশনের কি নাম বলা যায় না?
ওই যে পাঁশকুড়া|
আপনিও!
না, ঠিক ছিল না, জানেন| হঠাৎ মত বদলালাম|
কেন, কোনও কাজে যাচ্ছেন না বুঝি!
না| শুধুই এক অলস ভোর-সফর| আপনি?
আমি বাড়ি ফিরছি|
এই ভোরে একা!
আসলে আমি গ্রামের ভোর দেখিনি কতদিন|
আমি তো গ্রামে থেকেও ভোর-আস্বাদ থেকে বঞ্চিত| অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতেই বারোটা বেজে যায়|
আপনার?
আরে না, আমার বারোটা নয়, আমার সময়ের বারোটা. আমার অভ্যাসের বারোটা, আমার যাপনের বারোটা|
টগবগিয়ে হাওয়া ঢুকছে ট্রেনের নির্মেদ কামরার অন্দরে|
গোলাপি টপও দুলছে ঈষৎ, বাতাসের অদম্য ছটফটানিতে| আমার মনের দোলনাও দুলে উঠছে|
এমন রমণীস ভোর যে কতদিন চাক্ষুস করিনি|
বসা যাক| ফাঁকা সিটের দিকে ইশারা করল সবুজ রঙে রাঙানো নরম ঢেউখেলানো নখগুলো|
জানলার ধারের সিটটা ছেড়ে দিলাম| অজ্ঞাতনামা বসতেই ছোট স্কার্ট আরও ছোট হল| গমরঙা দুই উরু একপলক ধরা দিয়েই হারিয়ে গেল দৃষ্টির বাইরে| উষ্ণ কমলা ঠোঁট জায়গা করে দিল মুক্তোর মতো সাদা দন্তরাশিকে|
মন বলছে, এ পথ যদি না শেষ হয়
আমি ধরা দেব তোমার মন-জোছনায়
সবুজ যেন ক্রমেই জাঁকিয়ে বসছে ট্রেনের জানলার আলপথে| পুকুরের টলটলে কালচে জলে খেলা করছে মরাল-মরালি| বাঁশপাতার শনশনানি যেন এত দূরেও ধেয়ে এসে কান জুড়িয়ে দিচ্ছে|
মাঠে কচিকাঁচার দল বল নিয়ে দাপাচ্ছে| মাঠভর্তি সবজেটে ধান, ফুলকপির কী বাহার! দুহাত বাড়িয়ে সটান দাঁড়িয়ে থাকা কাকতাড়ুয়া যেন বলছে, খবরদার এ পাশে এসো না| সে বারণ শুনতে কালো কাকের ভারী বয়েই গেছে| জোড়া শালিকও নির্লজ্জ| মেঠো চড়াই কাকতাড়ুয়ার কান কামড়াতে ব্যস্ত| পক্ষীকুলে কেমনতরো হইচই| অতিষ্ঠ কাকতাড়ুয়া হেরে গিয়ে মাথা কাত করে কেতরে পড়েছে|
দেখুন দেখুন, কী সুন্দর| আমগাছের ডালে দুই ফিঙের ঠোঁটে ঠোঁট রাখা আলাপন| জানলার ওপর থেকে ঝুলতে থাকা আমার হাতের ওপর কেমন যেন নরমতার স্পর্শ| অজানা এক অনুভূতিতে আচ্ছন্নতার রেশ শরীরের ভাল লাগার বদ্ধতাকে খুলে দেয় সংগোপনে|
হেমন্তের সুখছোঁয়া ভোর যে এমন মন্ত্রমুগ্ধতার বীজ বপন করতে পারে, তা জানা হয়নি|
এটা কোন স্টেশন?
বোধহয় মেচেদা|
জল খাবেন?
আমি হাত বাড়াতে…
এ মা, মুখ দিয়ে খেয়ে ফেললাম যে…
একটু আগেই আকাশ-নীল জলের বোতলে মুখ দিয়ে জল খেতে দেখেছি| থুড়ি, বলা ভাল, ঠোঁট লাগিয়ে| আর ওই নল্র ঠোঁটের স্বাদ যে এভাবে পাব, ভাবিনি| হাত বাড়িয়ে বোতল নিয়ে ঠোঁটে রাখলাম| এমন আবেশময় গন্ধ কোনওদিন পাইনি|
চোখের নীরবতা হঠাৎ সচকিত| ঘন কালো গভীর মণিতে খেলা করে আচম্বিক কুটুম্বিতা| তিরতিরে কম্পনে কমলাসম ঠোঁটযুগলে সহাস্য আত্মীয়তা|
ট্রেন থেকে নেমে কোথায় যাবেন?
কোথাও না| ফিরে আসব| ভোরের প্রকৃতি দেখার স্বাদ পূর্ণ| প্রকৃতি যে এভাবে এত কাছ থেকে এত অন্তরঙ্গভাবে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অতিযত্নে আত্মিক হয়ে উঠবে, ভাবিনি|
তাহলে এখন কী ভাবছেন?
ভাবছি…
ভাবতে হবে না| আমার বাড়ি চলুন| দেখবেন, মায়ের সঙ্গে আলাপ হলে আপনার খুব ভাল লাগবে|
সটান বাড়ি!
এক অদ্ভুত টান অনুভব করছি কেন?
শর্ট স্কার্ট হাত ধরল|
হাত ছাড়তে পারলাম না|
স্টেশন থেকে হাঁটাপথে ৬ মিনিট ১৬ সেকেন্ড| ঘড়ির দিকে চোখ গেল| ৬.১৬|
আপনার নামটাই তো জানা হল না|
কী হবে নাম জেনে? আসুন|
কলিং বেল বাজার পর দরজা খুললেন এক মহিলা| চমকে উঠলাম| এক ধাক্কায় পিছিয়ে গেলাম প্রায় ১৯টা বছর| এ কী দেখছি আমি!