আজকে স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষে দৃষ্টি থেকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কিছু কথা —

0


HnExpress অরুন কুমার ঃ স্বাধীনতা মানে কি আসলে ক্ষমতার বিস্তার? আজ স্বাধীনতার ৭৫তম দিবস। বালিশে মাথা গুঁজে ভাবছিলাম, ছোটোবেলার কথা। কত আনন্দ, উচ্ছ্বাস এই দিনটির জন্য ছিল। ভোর হতেই ঘুম থেকে উঠে পরিষ্কার ইউনিফর্ম পরে স্কুলে যাওয়া। সাথে থাকত তেরঙ্গা অর্থাৎ আমাদের জাতীয় পতাকা, কিছু কুচো ফুল আর মালা। সারাদিন ধরে নানা অনুষ্ঠান চলতো। আবৃত্তি, তাৎক্ষণিক বক্তৃতার পাশাপাশি নাচ-গান-নাটক-ড্রিল ইত্যাদি ইত্যাদি।
ফেরার সময় স্কুল থেকে পেতাম মিষ্টির একটা প্যাকেট। খুশিতে ভরে যেত মনটা। সেই মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে আনন্দের সাথে বাড়ি ফিরতাম।

কিন্তু এত কিছুর মাঝেও সেই সময় ওই ছোট্ট মস্তিষ্কে স্বাধীনতার কতটুকু বুঝতাম ঠিক বলতে পারছি না, তবে হ্যাঁ বীর বিপ্লবী বঙ্গ মায়ের সন্তানদের জন্য বিনম্র মাথা ঝুঁকে যেতো আপনা আপনিই। এরপর ধীরে ধীরে শিক্ষার পাশাপাশি অভিজ্ঞতা অর্জনের নিরিখে এখন অনেক অজানা তথ্য জেনেছি। জেনেছি কতকগুলো ষড়যন্ত্রের কথা। সেই কারণেই ছোটোবেলার জানা কথা গুলো এখন আংশিক ফিকে। যে দৃষ্টিতে তখন দেখেছিলাম এখন পর্যায়ক্রমে দৃষ্টি পরিবর্তিত হয়েছে দৃষ্টিভঙ্গিতে। এ বিষয়ে নিজের কিছু কথা তুলে ধরছি আপনাদের সামনে।

এখন আর সেভাবে স্বাধীনতা দিবস নিয়ে মন লাফায় না। সস্তা হিন্দি ফিল্মের ডায়লগ শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে না। কারণ এখন বুঝেছি, স্বাধীনতার আসল মানে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক, কিন্তু তথাপি পরাধীনতায় জীবন কাটে আজও। এটাও একটা কঠিনতম বাস্তব সত্য। কিন্তু বাস্তবে তবুও অপরদিকে এই স্বাধীনতা দিনটি উপলক্ষে আমরা এখনো একই রকম ভাবে উচ্ছ্বসিত হই। আমরা অনেকেই এখনও বুঝতে পারি যে আমরা পুরোপুরি স্বাধীন তো নই, বরং এখনো পরাধীন। একদিন তাঁরাও বুঝবে স্বাধীনতা মানে আসলেই ক্ষমতার বিস্তার।

শাসকের হাতে শোষন হওয়ার নামই এই স্বাধীনতা। হয়তো দৃষ্টি থেকে দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তর এভাবেই হতে থাকবে। আসছি এ প্রসঙ্গে আলোচনায়, তার আগেই একটু দেখেনি, চোখ বুলিয়ে নিন আজকের প্রেক্ষাপটে। শহরের নামি দামী রেস্টুরেন্টের ওয়েটারকে “কিপ দা চেঞ্জ” বলার চাইতেও বেশী আত্মসন্তুষ্টি উপভোগ করা যাবে বলে মনে হয়। কতদিনই তো অমুক রেস্তোরার মেনুকার্ড চিরুনি তল্লাশি করে “ধিনচ্যাক মাটন কবিরাজী” অর্ডার করে শেষমেশ ঢেঁড়সসেদ্ধসম লেগেছে। স্থান, কাল, পাত্র বুঝে দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টানো দরকার।

এই বাস্তবটা বুঝতে হবে যে, মানুষ এখনও রোবট হয়ে ওঠেনি। গরীবের অন্ন যোগানোর চেষ্টাতে একটুখানি হার স্বীকার করলেও তাতে খুব বেশি গ্লানি আছে বলে মনে হয় না। এ বিষয়ে উল্লেখ করতে হয় কবির কথায়, “পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি”। কিছু ক্ষেত্রে এরকম মানসিকতা রাখার অভ্যাস আমাদের করতে হবে, পটলের গায়ে কিঞ্চিৎ ব্রণ থাকলেই ঠকবাজ তকমা দাগানোর আগে। এমন এক সমাজ-বান্ধব মনষ্ক দৃষ্টিভঙ্গি আসুক আমাদের মধ্যে, সমাজের দায়িত্বশীল মানুষের মধ্যে, যেখানে সবাই নিদেনপক্ষে মাটিতে পা রেখে চলবে।



ধনীরা না হয় সহাস্য বদনে হেঁটেই বেড়াক, আর গরীবের অন্তত হামাগুড়ি দিয়ে, ক্ষতি কি তাতে?
প্রসঙ্গত মহামতি দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলে ছিলেন, একটি সমাজের উৎকর্ষতা নির্ভর করে নিম্নশ্রেণীর মানুষের প্রতি উচ্চশ্রেণীর মানুষের কেমন দৃষ্টিভঙ্গি তার উপরে। এটাও যথেষ্ট বাস্তব সত্য আজকের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে। একটা বিষয়ে অধিকাংশ মানুষকে ভাবায় তা হলো এই, বর্তমানে আমাদের স্বাধীন ভারতে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ধনীরা আরও ধনী হয়ে চলেছে আর পক্ষান্তরে গরীবেরা আরও গরীব। এর সমাধান তখনই সম্ভব যখন অর্থের অবাধ এবং স্বতস্ফূর্ত প্রবাহ ধনী থেকে গরীবের দিকে হবে।

ঠিক যেমনটা পরমাণুর উচ্চশক্তি সম্পন্ন কক্ষের ইলেকট্রনগুলো অতিরিক্ত শক্তি ত্যাগ করে নিম্নশক্তি সম্পন্ন কক্ষে নেমে আসে এবং স্থায়ীত্ব লাভ করে‌ বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ও নিউটনের তত্ত্ব অনুযায়ী। আবার একটু দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে দেখা যাক এই ভাবে, ফুটপাতে বসে থাকা মুচির সামনে দিয়ে গেলে দেখা যাবে সে আমার আপনার জুতোর দিকে ছলছল করে তাকিয়ে আছেন। চাহনিতে এটা স্পষ্ট তার চোখে আশার আলো দেখছে সে। আর যখনই আপনি ওনাকে অতিক্রম করে যাবেন ক্রমশ তার দৃষ্টিটা ফিকে হতে থাকে।

এখানে একটা বড় প্রশ্ন আজকের স্বাধীনতা, ভারতের নতুন প্রজন্ম তথা সমাজ সচেতন মানুষের, সমাজের একশ্রেণীর মানুষ কেন এই চোখের ভাষা দৃষ্টি পড়তে পারে না? দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে নাকি অন্য কিছু? আরো প্রশ্ন বা জানার ইচ্ছে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ক্রমশ জাগ্রত হচ্ছে তা হল এই – “চোখের এই ভাষা বোঝার বিদ্যা কোন সাবজেক্টে পড়ানো হয় কিনা তা জানা নেই আমাদের অনেকেরই। তবে অচীরেই এই শিক্ষার প্রয়োজন হয়ে পড়বে বা বলা যায় এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে হবে।” এটাও সত্যি নিজের কাজ নিজে করা ভালো।

কিন্তু আবার এটাও দেখতে হবে, আজ সবাই যদি নিজের জামা কাপড় নিজেরাই পরিস্কার করতে শুরু করি, নিজের জুতো নিজেই সেলাই করি, পায়ে হেঁটে হাটে বাজারে যাই তাহলে এই প্রবাহ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে পড়বে। তাই সবার কাছ থেকে “না-নিলেও-চলে” টাইপের পরিষেবা গুলোও আমাদের নেওয়া উচিত। কোথাও ঘুরতে গেলে অপ্রয়োজনে রিকশা-ভ্যান ব্যবহার করুন বা মাথা ম্যাসাজ করান সেলুনে গিয়ে বা স্বল্পস্বাদ হওয়া সত্ত্বেও ভেলপুরী, ডিমসেদ্ধ খান। সমাজে এমন কিছু মানুষ এখনো আছে আজও যাঁদেরকে এই ধরনের ছোট ছোট জীবিকার মধ্য দিয়ে নির্বাহ করতে হয়। তাই একে অপরের পরিপূরক বিষয়টি মাথায় রেখে দৃষ্টিভঙ্গি একটু মানবিক হওয়া উচিত নয় কি!

ফিরে আসি আবার আলোচনার মূল প্রসঙ্গে।
প্রতিবছর মহাসমারোহে ভারতবর্ষে উদযাপিত হয় ১৫ই অগস্ট দিনটি। স্বাধীনতা দিবসের এই বিশেষ দিনে তেরঙ্গাতে সেজে ওঠে ১৩০ কোটির মাতৃভূমি। বন্দে মাতরম, জয় হিন্দ ধ্বনি শোনা যায় এই বিশাল দেশের নানা অলিতে গলিতে, আনাচে কানাচে থেকে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে। যদিও এইবার স্বাধীনতা দিবস প্রতিবারের চেয়ে অনেক বেশি মাহাত্মপূর্ণ, কারণ এই বছর আমাদের ভারতবর্ষ ৭৫-তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করল।

১৯৪৭ সালের ১৫ই অগস্ট ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীনতা লাভ করে ছিল আমাদের দেশ সুজলা সুফলা ভারতবর্ষ। তবে যে প্রশ্ন সকলের মনেই আসে, যে কেন বিশেষ ভাবে এই ১৫ই আগস্টের দিনটিকেই বেছে নেওয়া হলো ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে? ইতিহাসে উল্লেখ আছে যে, পরাধীন ভারতের শেষ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতার দিন ঠিক করার। হঠাৎই মাউন্ট ব্যাটেনের জাপানের আত্মসমর্পণের দিনটির কথা স্মরণে আসে। আর সেই কারণেই ১৯৪৭ সালের ৪ঠা জুলাই, মাউন্ট ব্যাটেন এই ১৫ই অগস্ট দিনটির কথা ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সে এর সামনে তুলে ধরেন।

এ বিষয়ে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন বলেছিলেন, ‘আমি কোনও পূর্ব পরিকল্পনা থেকে দিনটি বেছে নেইনি। আমি এটা যেনতেন প্রকারে প্রমাণ করতে মরিয়া ছিলাম যে, এই গোটা কর্মকাণ্ডের নায়ক আমি। আমাকে যখন ওরা একটা তারিখ বেছে নিতে বলেছিল, আমি জানতাম এই দিনটা খুব কাছে। তবে তখনও আমি জানিনা ঠিক কোন দিনে এটা হতে চলেছে। ভাবছিলাম অগস্ট কিংবা সেপ্টেম্বরের মধ্যেই কোনও একটা দিন হবে। তখনই আমার মাথায় আসে ১৫ই অগস্টের কথা।

তিনি আরও বলেন, আমার মনে হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের আত্মসমর্পণের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিই হবে শ্রেষ্ঠ দিন।’ আর এই কারনেই মাউন্ট ব্যাটেনের কাছে এই ১৫ই আগস্ট দিনটি মঙ্গলজনক বলে মনে হয়েছিল। আসলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৫ সালের ১৫ই আগস্ট মাউন্ট ব্যাটেনের নেতৃত্বে থাকা সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল জাপানের সেনাবাহিনী, আর সেই জন্যই এই দিনটিকে শুভ মনে করতেন তিনি। অনেক ইতিহাসবিদদের ধারণা মাউন্ট ব্যাটেনের কাছে এই ১৫ই আগস্ট তারিখটিকে বিশেষ কারণে শুভ বলে মনে হয়েছিল আর তাই তিনি ওই তারিখটি বেছে নেন ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে।

তারপর দেখতে দেখতে পুরো ৭৫টি বছরের মাইলস্টোন পেরিয়ে এসেছি আমরা। আজ থেকে ৭৫ বছর আগে মধ‍্যরাতে ভারতবর্ষকে দু-টুকরো করে স্বাধীনতার নামে ক্ষমতার হস্তান্তরের এক-টুকরো কাগজ ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল ব্রিটিশ ভক্ত নেতাদের হাতে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারত আজও ব্রিটিশ কমনওয়েলথের মধ‍্যে এক সদস‍্য দেশ হিসাবেই রয়েছে। তাহলে নেতাজী সহ ভারতবর্ষের সমস্ত বিপ্লবীদের সাথে কি আমরা দ্বিচারিতা করলাম না? আমাদের মধ‍্যে আর ভক্তির বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট কিছু নেই।

সমাজতন্ত্র আজ শুধু সংবিধানের পাতাতেই লেখা আছে, বাস্তবে ভারত তার থেকে বহু বহু মাইলস্টোন দূরে। ধর্মকে আমরা রাজনৈতিক ব‍্যবসায় পরিণত করেছি। বেইমানি আমাদের রক্তে মিশে গেছে। আমরা নেতাজীকে নিজেদের স্বার্থে ব‍্যবহার করতে শিখে গেছি। এর থেকে চরম লজ্জার আর কী আছে গোটা দেশবাসীর? আজও আমাদের দেশে স্বার্থান্বেষী মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে, দুর্নীতি, বেকারত্ব, দারিদ্রতা এই সমস্ত বিষয়গুলি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে সমগ্র দেশকে। অভুক্ত মানুষের সংখ্যা কম নয়। এরকম অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি। এর সমাধানের পথ কোথায়? কিভাবে?

পরাধীন ভারতে জাতীয় কংগ্রেসের কিছু নেতা স্বামী বিবেকানন্দের কাছে আবেদন রেখে ছিলেন, স্বামীজি আপনি জাতীয় কংগ্রেসে আসুন নেতৃত্ব দিন, দেশকে স্বাধীন করার কাজে ব্রতী হোন। স্বামী বিবেকানন্দ তখন কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দকে বলেছিলেন,”আমি দেশের স্বাধীনতা কালই এনে দিতে পারি, কিন্তু তোমরা কি সেটা ধরে রাখতে পারবে?” এ কথা আজও অতিব প্রাসঙ্গিক। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তৎকালীন দেশের নেতৃবৃন্দ কতটা মানসিক ও প্রশাসনিক ভাবে দেশ ও সমাজকে নেতৃত্ব দেওয়ার অবস্থায় ছিল।

এই দৃষ্টি ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে স্বামী বিবেকানন্দ যে কথাগুলো বলেছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কথা আজও প্রাসঙ্গিক ও প্রযোজ্য বলা যায়। তার বেশ কয়েক বছর পর কথাই সমান ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন অপর এক ভারত বরেণ্য সন্তান নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয়‌ যে, সুভাষচন্দ্র বসু এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু— এই দুই জীবনেই বহু বহু বরণীয় স্মরণীয় ঐতিহাসিক কীর্তির প্রেরণার উৎস এই একাগ্র নিঃস্বার্থ ভক্তি তা হল দেশভক্তি। ভক্তি কি হঠাৎ জন্মায়? না, এই ভক্তি আসে অগাধ বিশ্বাস আর ভালোবাসা থেকে। কাউকে অন্তর দিয়ে গভীর ভাবে ভালো না বাসলে ভক্তি আসে না।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন- “আমার চরিত্রের সর্বপ্রধান ত্রুটি হল, আমি আমার দেশকে ভালোবাসি। আর হ‍্যাঁ একান্ত ভাবে ভালোবাসি।” গুরুর এই ত্রুটি শিষ‍্যা নিবেদিতার চরিত্রে প্রবল ভাবে প্রবেশ করেছিল। গুরু-শিষ‍্যার এই মিলিত ত্রুটি সর্বাংশে প্রবেশ করেছিল সুভাষচন্দ্র বসুর চরিত্রের মধ‍্যেও। জীবনের প্রতি মুহূর্তে প্রতি ক্ষণে সুভাষচন্দ্র এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্র কখনও ভোলেননি গুরু স্বামীজীর সেই আহ্বান – “ভুলিও না.. জন্ম হইতেই তুমি মা’য়ের পায়ে বলি প্রদত্ত।”

ইতিহাসের পাতায় একটু পিছনে ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাব, সেবার দেশবন্ধুর প্রয়াণ বার্ষিকী উদযাপিত হবে কাশীতে। তার প্রস্তুতি চলছে। সুভাষচন্দ্র বসু তখন কাশীতে আছেন।
দশাশ্বমেধ ঘাটে হয়েছে এই সভার আয়োজন, শুরু হবে সন্ধ‍্যা ছ’টায়। লোকে লোকারণ‍্য হয়ে গিয়েছে এলাকা। কিন্তু, সাড়ে পাঁচটা বেজে গেলেও সুভাষচন্দ্রের দেখা নেই। চারিদিকে খোঁজার পর অবশেষে তাঁকে পাওয়া গেল কাশীর হরিশ্চন্দ্র-ঘাটের শ্মশানের ধারে। সেখানে তখন মড়া পুড়ছে, ধোঁয়া আর চামড়া পোড়ার গন্ধ চারিদিকে।

সুভাষচন্দ্র বসে আছেন এক সিঁড়ির ধারে। তাঁর পাশে সারা গায়ে ভস্ম মাখা এক নাগা সাধু। সুভাষচন্দ্র জিজ্ঞেস করছেন সেই সাধু’কে – “দেশ স্বাধীন কবে হবে?” কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সাধু বললেন – “দের হ‍্যায়।” আর কত দেরি? উত্তর আসে, “বলিদান যব পুরা হোগা।” সুভাষচন্দ্র এই কথাটি জীবনের প্রতি মুহূর্তে প্রতিক্ষণে অনুভব করেছিলেন এবং পরবর্তীতে তিনি কখনও ভোলেননি গুরু স্বামীজীর সেই আহ্বান- “ভুলিও না, জন্ম হইতেই তুমি মা’য়ের পায়ে বলি প্রদত্ত।” বলিদান এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। সম্পূর্ণ করার অধিকার ভারত-বিধাতা আমাদের আর দেবেন না।

আজকের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৭৫তম বর্ষপূর্তি উদযাপন হবে, সারা বছরের ৭৫টি সপ্তাহ ধরে সরকারি বেসরকারি ক্ষেত্রে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন হবে। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষের মূল সমস্যাগুলির সমাধানের পথ যে মহানায়ক দেখেছিলেন আজ থেকে ১২৫ বছর আগেই স্বাধীনতার যুদ্ধের সময়, তা বাস্তবায়িত না হলে আজকের এই স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষপূর্তির এই অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বলিদান ও তাদের দেশমাতৃকার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কতটা প্রতিফলিত হবে তা হয়তো সময়ই উত্তর দেবে।

তবে একটা কথা উল্লেখ করতে হয় যে যেমন স্বাধীনতা আন্দোলনে বিভিন্ন সময়ে যে সমস্ত বীর বিপ্লবীরা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন তার পরবর্তী সময়ে নতুন প্রজন্ম এই নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন, ঠিক তেমনি আগামী দিনগুলোতে এই ৭৫ বছরের মাইলস্টোনে একটার পর একটা সাফল্য প্রাপ্তির বিষয়গুলি নিয়ম চুলচেরা বিশ্লেষণ করবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। সুতরাং যারা আমাদের দেশের কর্ণধার দেশকে পরিচালিত করছেন সমাজকে পরিচালিত করছেন তাদের দৃষ্টি, দৃষ্টিভঙ্গির সম্যক পরিবর্তন এবং তার বাস্তবায়ন সঠিকভাবে না হলে আগামী প্রজন্ম আমাদের কোনদিনই ক্ষমার চোখে দেখবে না।

FacebookTwitterShare

Leave a Reply Cancel reply