এবারে ভেসে উঠল বাংলার বুকে অভিনব এক ভাইফোঁটার চিত্র

0
যেকোনো ধরনের ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন আমাদের সাথে। যোগাযোগ ঃ ৬২৮৯২৩৫০৭৬

 

HnExpress ১৭ই নভেম্বর, অরুণ কুমার ঃ গতকাল ভেসে উঠল বাংলার বুকে অভিনব এক ভাইফোঁটার চিত্র। সোমবার ছিল ভাইফোঁটার দিন। সকাল থেকেই রীতি রেওয়াজ সহকারে বাঙালি হিন্দুর ঘরে ঘরে এই উৎসব পালন হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এই উৎসব বাঙালির ঘরে ঘরে পালিত হওয়া এক বর্ণময় অনুষ্ঠান। পরিবারের আপনজনদের নিয়ে আয়োজিত ভাইফোঁটার সেই চিরাচরিত উচ্চারিত বাণী, “ভাইয়ের কপাঁলে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।”

বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে ভাইয়ের কপালে চন্দন-দধীর মঙ্গল ফোঁটা দিয়ে ভাইয়ের জন্য দীর্ঘ আয়ু কামনা করা হয়। সাথে উচ্চারিত হয়, “যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা। মৃত্যুর দূত যমকে তার বোন যমুনা ফোঁটা দেয়, অমরত্ব প্রদানে সেই অর্থে আমরা মর্ত্যবাসীগণ ভাইকে ফোঁটা দিই যমের থেকে ভাইয়ের জন্য অমরত্ব আদায়ের লক্ষ্যে।”

ভাইফোঁটার পোষাকি নাম ভাতৃদ্বিতীয়া অনুষ্ঠান। কার্তিক মাসের শুক্লাদ্বিতীয়া তিথিতে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বোনেরা তার ভাইয়ের দীর্ঘায়ু এবং সুস্থ জীবন কামনায় ফোঁটা দিয়ে, তারপর মিষ্টি মুখ করায়। এরপর বোন তার ভাইয়ের মাথায় ধান দুর্বা ঘাসের শীষ রাখে, আর দাদা হলে সেই বোনের মাথায় আশির্বাদী ধান-দূর্বা রাখে। সঙ্গে উলুধ্বনি সহকারে শঙ্খ বাজানো হয়। বোন যদি ছোটো হয়, তখন ভাই বোনকে আশির্বাদ করে।

 

 

পশ্চিমবঙ্গে এই উৎসব বাঙালির ঘরে ঘরে এক বর্ণময় অনুষ্ঠান। পরিবারের সকলে মিলে বেশ উৎসাহ এবং উদ্দীপনার সাথে এই উৎসব পালন করে। সকাল থেকেই বিভিন্ন রীতিনীতি মেনেই আয়োজন শুরু হয়। তারপর আসল অনুষ্ঠান সম্পন্ন হওয়ার পর চলে পেট পুজো ও উপহার আদান প্রদান। এক কথায় এই দিনটি ঘিরে পরিবারের সকল সদস্যের এক হওয়া, যেন এক অন্য মাত্রা বহন করে আনে সংসারের মঙ্গল প্রার্থনায়। মূলত এই ফোঁটা ভাই-বোনের পবিত্র সম্পর্কে আরও বেশি অটুট ও সম্মানীয় করে তোলে।

এরই পাশাপাশি আমরা দেখতে পেলাম আরো অনেক অভিনব ভাইফোঁটার ব্যতিক্রমী চিত্র।
পারিবারিক পরিসীমার বাইরেও আমরা পেলাম সেই দৃশ্য। এই ভাইফোঁটার দিনে এক ব্যতিক্রমী ভাবনা নিয়ে ভাইফোঁটা পালন করলেন উত্তরবঙ্গ এর শিলিগুড়ির বিধাননগরের পুলিশকর্মী তথা সমাজকর্মী বাপন দাস। আজ তিনি বিধান নগর এলাকার জাতীয় সড়কের পাশে যে সকল মহিলা ভবঘুরেরা থাকেন, সেই সকল মহিলা ভবঘুরেদের কাছ থেকে ভাইফোঁটা নিলেন, আর তাদের করালেন মিষ্টিমুখ, দিলেন নতুন বস্ত্র।

এক ব্যতিক্রমী মানুষ কলকাতা পুলিশের বিশেষ শাখার কর্মী এই বাপন দাস। তিনি জানিয়েছেন, এই ভবঘুরেরা কারো দিদি বা বোন হতে পারে, তাই তাঁদের একটু আনন্দ দিতে এই চেষ্টা এবং তিনি সকল ভাই-বোনদের ভাইফোঁটার শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। আবার আমরা দেখতে পেলাম করোনা মহামারী মোকাবিলায় যারা প্রথম সারিতে থেকে লড়াই করছেন ডাক্তার পুলিশের পাশাপাশি সহযোগী হিসেবে সিভিক ভলেন্টিয়ার তারাও এবারে বোনেদের কাছ থেকে একটু অন্যভাবে ভাইফোঁটা পেলেন।

 

 

আমরা আরও দেখতে পেলাম যে, দক্ষিণবঙ্গের শ্যামনগরের একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত ভাতৃদ্বিতীয়ার মঙ্গল অনুষ্ঠান। এবারের ভাইফোঁটাতে সিভিক ভলেন্টিয়ার, পথ শিশু ও বোনদের ফোঁটা দানের মাধ্যমে সারা পশ্চিমবঙ্গে এক অনন্য নজির সৃষ্টি করল শ্যামনগরের সমাজ সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন।
জানা গিয়েছে, তাঁরাপীঠ তপোবনের প্রতিষ্ঠাতা গুরুজি বিনয় মহারাজ এর অনুপ্রেরণায় সমাজ সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আজ শ্যামনগর চৌরঙ্গী মোড়ে অনুষ্ঠিত হয় এক অভিনব ভাইফোঁটা।

সমাজ সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, করোনা যুদ্ধে চিকিৎসক, পুলিশ প্রশাসন নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন। একই সাথে সিভিক ভলেন্টিয়াররাও নিজেদের জীবনকে বাজি রেখে প্রতি মূহুর্তে রোদ, জল, ঝড়-বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে প্রতিনিয়ত রাস্তায় দাড়িয়ে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখছেন। তাদের এই অসামান্য অবদানের প্রতি কুর্নিশ জানাতেই আমাদের আজকের এই ছোট্ট উদ্যোগ।

ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের জগদ্দল ও নোয়াপাড়া থানায় কর্মরত আতপুর সাব ট্রাফিক গার্ডের সিভিকদের ভাইফোঁটা দেন সমাজ সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের সাথে যুক্ত মহিলা সদস্যারা। সেইসঙ্গে ফোঁটা দেওয়া হয় পথ শিশুদেরকেও। একই সাথে সেখ আব্দুল সালাম ফোঁটা নিলেন এই সংস্থার মহিলা সদস্যাদের কাছ থেকে। এক অভিনব পন্থায় ভাইফোঁটার সাক্ষী থাকল শ্যামনগরবাসি। আরও নানান ছবি দেখতে পাওয়া গেল বীরভূমের সদর সিউড়িতে।

 

 

আরও একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আজ মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি, অসহায় আশ্রয়হীন এবং পথবাসীদের নিয়ে ভাইফোঁটার আয়োজন করে। সংস্থার সদস্যরা একটি ভ্রাম্যমাণ টিম নিয়ে সকাল থেকেই সিউড়ি স্টেশনপাড়া, রবীন্দ্রপল্লী, এস পি মোড়, এমন বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয়হীন নারী-পুরুষদের ভাইফোঁটা দেন। সেই সঙ্গে নতুন জামাকাপড়, মিষ্টি এবং উপহার সামগ্রীও তুলে দেওয়া হয়।

এমনই এক অভিনব ভাইফোঁটার কথা যেন উল্টো পুরাণ। ভাইফোঁটার দিন ভাইকে নয় বোন দিচ্ছে বোনকে ফোঁটা, যম দুয়ারে পড়ল কাঁটা। দিদির হাতের আশীর্বাদে বোনের সকল বিপদ যেন কাটে। বোন চাইছে দিদির ভালো। বোনে বোনে জগৎ আলো। ভাই নেই তাঁতে কি হয়েছে। ভাইফোঁটার আনন্দ উপভোগ থেকে তো আর বিরত থাকা যায় না। তাই ভাই না থাকার আক্ষেপ মেটাতে বোনকেই ফোঁটা দিল আরেক বোন। এবার তারা এই বোনফোঁটা দিয়ে আনন্দ উপভগ করল।

আনন্দ উপভোগে সামিল হল মাথাভাঙা শহরের আমলা পাড়া ৬নং ওয়ার্ডের অধিকারী পরিবার।
“দিদি ও বোনের ভালোবাসা, দিদির গর্ব বোনের আশা। বাঁধনটি বেশ অটুট থাকুক, নতুন আলোর ভরসা জাগুক।” ভাবছেন ভুল মন্ত্র উচ্চারণ করছে! না এই মন্ত্র পাঠ করেই বোন ফোঁটা পালন করছেন ঐশ্বর্য। বছর ১৬ ঐশ্বর্য অধিকারীর ছোট বোনের বয়স ২ বছর। নাম আরাত্রিকা। প্রতি বছর ভাইফোঁটায় ঐশ্বর্যর আক্ষেপ থাকত তার কোন ভাই নেই। ছোট বোনকে নিয়ে সে এই দিনটির অপেক্ষায় ছিল।

 

 

আর ভাইফোঁটার দিন সে আনান্দ থেকে বিরত থেকে নয় নিজের বোনকে ফোঁটা দিয়ে ঐশ্বর্য ভাইফোঁটার আনান্দে মাতলো। এদিন ঐশ্বর্য বোনফোঁটা দেওয়ার পর জানান ভাইফোঁটা হলেও বোনফোঁটা কেন হয় না? তার কোন ভাই নেই। তবে তার বোন ভাইয়ের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। মেয়েরা যখন সব দিক দিয়েই পায়ে পা মিলিয়ে পুরুষদের সঙ্ঘে এগিয়ে চলেছে। তখন সেখানে বোনফোঁটা দেওয়া যাবে না সেটা মানা সম্ভব নয়।

নিয়ম মত সকালেই বোনের কপালে ফোঁটা দিয়েছে ঐশ্বর্য। শুধু এবার নয়ই, প্রতি বছরই দুই বোন মিলে একে অপরকে ফোঁটা দেবে বলেই তারা ঠিক করেছে। মেয়ে ঐশ্বর্যের এই সিদ্ধান্তে খুশি তার বাবা সুব্রত ও মা শেফালি অধিকারী। তারা জানান মেয়েরা এখন কোনো অংশেই ছেলেদের থেকে কম নয়। মেয়েদেরও অধিকার রয়েছে আনন্দ উপভোগ করার। বোনফোঁটার প্রচলনও দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ুক এই কামনাই করে অধিকারী দম্পতি। এভাবেই বাংলার উত্তর থেকে দক্ষিণে দেখা গেল ভাইফোঁটার আনন্দ উপভোগের মধ্যে দিয়ে এই অভিনব সম্প্রীতির চিত্র।

FacebookTwitterShare

Leave a Reply Cancel reply