জগদ্ধাত্রী পুজোর ইতিকথা ঃ কৃষ্ণনগর—

0

HnExpress ২৫শে নভেম্বর, বাংলার ঐতিহ্য, প্রিয়দর্শী সাধুঁখা ঃ বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। এই তেরো পার্বণকে ঘিরেই বাংলার ঘরে ঘরে বিভিন্ন পুজো হয়ে থাকে। শারদীয়ার পরেই বিজয়া, তারপর একে একে লক্ষ্মী পুজো, দীপাবলি, ভাইফোঁটা, কার্তিক পুজো শেষে শুভারম্ভ হয় জগদ্ধাত্রী পুজোর। ইতিহাসের পাতাতে জগদ্ধাত্রী পুজোর জনশ্রুতি আর ইতিহাস মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে ‘বাংলার বিক্রমাদিত্য’ কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর প্রবর্তিত জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন থেকে।

সালটা ১৭৫৪। প্রচলিত কাহিনি অনুসারে নবাব আলিবর্দি খানকে সে বার রাজকর দিতে না পারায় কারাগারে বন্দি হয়ে ছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। কারাগার থেকে যেদিন মুক্তি পেয়ে ছিলেন তিনি, সেই দিনই ছিল বিজয়া দশমী। কৃষ্ণনগর ফেরার পথে ক্লান্ত, বিষণ্ণ রাজা নৌকার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে ছিলেন। জনশ্রুতি, সেখানেই কৃষ্ণচন্দ্র স্বপ্নে দেখেছিলেন যে এক রক্তবর্ণা চতুর্ভুজা কুমারী দেবী তাঁকে বলছেন, আগামী কার্তিক মাসের শুক্লানবমী তিথিতে তাঁর পুজো করতে।

কাহিনী এখানেই শেষ নয়। ১৭৫৪’র পর ১৭৬৪। আবার কারাগারে বন্দি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর পুত্র শিবচন্দ্র। কারন ইংরেজদের বন্ধু এই সন্দেহ বশত মীরকাশিম মুঙ্গেরের কারাগারে বন্দি করে ছিলেন। শোনা যায়, মীরকাশিম নাকি কৃষ্ণচন্দ্র এর প্রাণদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর দূত মারফত এই সংবাদ মেরতলার প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কালীশঙ্কর মৈত্রের কাছে পৌঁছে দিয়ে ছিলেন। এবং তাঁর প্রাণ রক্ষার প্রার্থনা জানিয়ে ছিলেন।

আর সেই কারাগারেই কৃষ্ণচন্দ্র এক কুমারী দেবীর স্বপ্নাদেশ লাভ করেন এবং কারাগার থেকে মুক্তিলাভের প্রতিশ্রুতি লাভ করে ছিলেন। জনশ্রুতি আছে, কিছু দিনের মধ্যেই তিনি সত্যিই কারামুক্ত হয়ে ছিলেন। কারামুক্ত হবার পরই তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শিবচন্দ্র ও তাঁর বিদূষক গোপাল ভাঁড়কে নিয়ে উপস্থিত হন মেরতলার প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কালীশঙ্কর মৈত্রের কাছে। খুলে বলেন স্বপ্নের কথা। কালীশঙ্কর তাঁকে জানান, এই দেবী স্বয়ং চণ্ডী। প্রাচীন কালে এই দেবীর পুজোর প্রচলন ছিল। তারপর শুরু হয় পূজার আয়োজন।

কার্তিক মাসের শুক্লা নবমীর তিথিতে দেবীর পুজোর বিধান দেওয়া আছে। হাতে সময় কম, কিন্তু রাজা পিছিয়ে যাবার মানুষ নয়। কিন্তু বাধা কুলপুরহিতকে নিয়ে। কারন রাজপরিবারের কূলগুরু ছিলেন বৈষ্ণবাচার্য। তিনি নতুন করে এই শাক্ত দেবীর পুজোয় অনুমতি না দিলে সেই পুজো করা সম্ভব হত না। তাই রাজা ঠিক করে ছিলেন, পুজোর আগের দিন মধ্যরাত্রেই কৃষ্ণনগরে ফিরবেন। আর পরের দিন সকালে অঞ্জলি দেবেন। তখন কূলগুরুর কোনও বাধাই কার্য্যকর হবে না।

শোনা যায় কালীশঙ্কর রাজাকে যথাযথ সাহায্য করে ছিলেন। পরের বছর থেকে চন্দননগরে পুজোর প্রচলন হয়ে ছিল ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর উদ্যোগে। “প্রপূজয়েজগদ্ধাত্রীং কার্তিকে শুক্লপক্ষকে দিনোদয়ে চ মধ্যাহ্নে সায়াহ্নে নবমেহহন।” এর অর্থ কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দিনের শুরুতে মধ্যাহ্নে এবং সায়াহ্নে জগদ্ধাত্রী পুজো করা যায়। বাংলার পাল-সেন যুগের বিভিন্ন তন্ত্র গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে সিংহবাহিনী জগদ্ধাত্রীর পুজোর।

কৃষ্ণনগরে বেশির ভাগ প্রতিমা যেখানে বিশাল আকারের, সেখানে রাজবাড়ির প্রতিমা অন্যান্য প্রতিমার চেয়ে আকারে কিছু ছোট। এর কারণ জানতে চাইলে সৌমীশবাবু বলেন, “স্বপ্নাদেশে কৃষ্ণচন্দ্র যে দেবীর দর্শন পেয়ে ছিলেন তিনি কুমারী রূপিনী। তাই দেবীর মূর্তি কুমারী বালিকার মতো। বর্তমানে প্রচলিত জগদ্ধাত্রী মূর্তির চেয়ে আলাদা কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ির প্রতিমা। আড়াআড়ি ভাবে নয়, দেবী সোজাসুজি সিংহের উপর বসে। সিংহটি দেখতে দাবানলের ঘোড়ার মতো। সামনে ঝুলন্ত অভ্রধারা।

কৃষচন্দ্রকে নিয়ে কথিত যে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র (১৭১০-৮৩) তৎকালীন বাংলার নবাব মিরকাসিম এর কাছে সময়ে খাজনা না দেবার কারণে মুর্শিদাবাদে বন্দি ছিলেন সে বছর (১৭৬১) শারদীয়া পূজার সময়। কাজেই দুর্গা পুজো করা সম্ভব হয়নি। তবে ছাড়া পেয়েই বিজয়া দশমীর দিনে নৌকায় ফেরার পথে স্বপ্নাদিষ্ট হন কার্তিক শুক্লা নবমীর সময় জগদ্ধাত্রী পুজো করার জন্যে। যথাবিহিত ভক্তি সহকারে তিনি জগদ্ধাত্রী পুজো করেন।

এরপর তিনি আরও বিভিন্ন জায়গায় এই পুজোর প্রচলনে উদ্যোগী হন। এই সূত্রেই তাঁর দেওয়ানজি দাতারাম সুর চন্দননগরের দক্ষিণে ভদ্রেশ্বরের গৌরহাটি বা গরুটি গ্রামের বাড়িতে ১৭৬২ সালে জগদ্ধাত্রী পুজো আরম্ভ করেন। এও কথিত যে রাজা নিজে নাকি দাতারাম সুরের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে ছিলেন সেই সময়ে। তবে এই কথা নিশ্চয় অতিরঞ্জিত, কেননা তখন কৃষ্ণনগর রাজবাটীতেও নিশ্চয় পুজো হচ্ছিল এবং পূজার সময় তিনি নিজ বাটি ছেড়ে গৌরহাটিতে আসবেন তা ভাবাই যায় না।

যাইহোক, তবে এই পুজো এখানে বাড়ির পুজো হিসাবেই চালু হয়েছিল প্রথমে। শূলপাণি খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকে কালবিবেক গ্রন্থে কার্তিক মাসে জগদ্ধাত্রী পুজোর উল্লেখ করেন। পূর্ববঙ্গের বরিশালে, খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে নির্মিত জগদ্ধাত্রীর একটি প্রস্তরমূর্তিও পাওয়া যায়। বর্তমানে এই মূর্তিটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালার প্রত্নবিভাগে রক্ষিত। কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালের আগে নির্মিত নদিয়ার শান্তিপুরের জলেশ্বর শিবমন্দির ও কোতোয়ালি থানার রাঘবেশ্বর শিবমন্দিরের ভাস্কর্যে জগদ্ধাত্রীর মূর্তি রক্ষিত হয়।

তথ্যসূত্র ও চিত্র ঃ উইকিপিডিয়া।

FacebookTwitterShare

Leave a Reply Cancel reply