ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কিত কু-মন্তব্যের প্রতিবাদে সোশ্যাল মিডিয়াতে ধিক্কার ঝড়ের মুখোমুখি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এর অধ্যাপিকা সুতপা সেনগুপ্ত
HnExpress ৪ঠা অগাস্ট, অরুণ কুমার, কলকাতা ঃ সম্প্রতি ফেসবুকে মহিলা কবি অধ্যাপিকার মন্তব্য পড়ে যারপরনাই লজ্জিত আমরা অনেকেই। যেখানে তিনি স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় এর সম্পর্কে কিছু কুরুচিপূর্ণ কথা লিখেছেন। এদিন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কিত সেই কু-মন্তব্যের প্রতিবাদে সোশ্যাল মিডিয়াতে ধিক্কার ঝড়ের মুখোমুখি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এর অধ্যাপিকা সুতপা সেনগুপ্ত।
আমরা অনেকেই জানি যে আধুনিক বাংলা ভাষার বর্ণমালা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দান। ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে এটাও প্রতিষ্ঠিত যে, পিছিয়ে পড়া ও অসহায় নারীর সামাজিক মানোন্নয়নের জন্য তিনি আজীবন লড়াই করেছেন। এবার আসছি মুল প্রসঙ্গে। আজকের দিনে দ্রুত যোগাযোগ হয়ে থাকে ফেসবুক দ্বারা, যাকে বলা হয় সামাজিক মাধ্যম। আমরা ঘরের ভেতর নিজের ঘনিষ্ঠতম পরিজনদের সঙ্গে যেভাবে মেলামেশা করি, কথা বলি বা যেই পোশাক পরে থাকি ঘরের বাইরে বৃহত্তর সামাজিক পরিসরেও কি ঠিক তেমন ভাবেই সবকিছু করে থাকি ?
আমাদের মনটা তো লাগামছাড়া। আমরা সচেতন ভাবে যা যা ভাবি তার চেয়ে অনেক বেশি ভাবি অবচেতনে। যেটাকে মনস্তত্ত্বে বলে সাব-কনশাস মাইন্ড। চিন্তার পরেই বাক্য। সারাজীবনে আমরা কত কথা বলি। ঘরের ভেতরে আমরা কত লোকের সম্পর্কে যা তা বলে থাকি। কিন্তু ঘরের সেইসব কথা হাটের মাঝে বললে বিপদ তো হবেই। ঘরে বসে কে যে কার নামে কী সব বলে মন্তব্য করে, তা ঘরের দেওয়াল গুলো সাক্ষ্য দিতে পারলে সবার মজা টের পাইয়ে দিত। কিন্তু ঘরের কথা সামাজিক পরিসরে বলা যায় না।
ছোটবেলায় বাবা মায়েরা এটা শেখায় বলেই অভিজ্ঞতা থেকে জানি। স্ত্রীর কাছে অফিসের বসকে শালা বলে আর অফিসে ঢুকে সেই বসকে স্যার স্যার বলতে বলতে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলি। এ দ্বিচারিতা আমরা দেখতেই পাই।
সম্প্রতি যে কথা এই সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক থেকে বিতর্কের ঝড় বৃষ্টির তীব্র থেকে তীব্রতর হতে আরম্ভ করেছে তাহল যাদবপুরের এক কবি অধ্যাপিকা, তাঁর শৈশবে তাঁর বাবার কাছে শুনেছিলেন বিদ্যাসাগর মহাশয় নাকি কলকাতার কুমোরটুলির কাছে উপপত্নী (গর্ভজাত সন্তান সহ) পুষতেন।
এখন ওই অধ্যাপিকা বাবার কাছ থেকে শোনা কথা ফেসবুকে উগড়ে দিয়েছেন। ফেসবুক এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী এক সামাজিক গণমাধ্যম। অর্থাৎ অধ্যাপিকা নিজের ঘরের মনগড়া বানানো কিছু কু-কথা সমাজের মধ্যে ছেড়ে দিয়েছেন। এখন সমাজ তো তাঁকে ছেড়ে কথা বলবে না। কারণ সেই গুণীমানী মানুষটার নাম যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যিনি সবার আগে মহিলাদের সম্মান করতেন, তাদের সুবিচার পাইয়ে দেওয়ার জন্য ব্রিটিশের ইংরেজ সরকারের সাথে পর্যন্ত লড়াই করেছেন, ইতিহাস এমনটাই বলছে।
তাছাড়া এখনো পর্যন্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উপর যত গবেষণা হয়েছে তাতে কোথাও তাঁর উপপত্নী বা রক্ষিতা থাকার কথা উল্লেখ মেলে নি। যদিওবা সমকালীন সমাজে এই একরোখা জেদি মানুষটির শত্রুরও অভাব ছিল না। অপরদিকে ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতায় উপপত্নী রাখার চল ছিল। সেই সময়কার অনেক বিখ্যাত অখ্যাত লোকের একাধিক পত্নী ছিল। এবার সেই অধ্যাপিকার পিতৃদেব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো কিংবদন্তী ব্যাক্তির জীবনের এমন একটা ঘটনা জানতেন, যা আমরা কেউ জানি না, জানতাম না, গবেষকরা জানতেন না!
এমনকি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শত্রুরাও পর্যন্ত জানতেন না, অথচ তা এক সাধারণ অধ্যাপিকা কবির মুখ দিয়ে যখন জাতি জানতে পেরেছে তখন জাতি কী করে চুপচাপ বসে থাকে? এটা আজকে বড় প্রশ্ন রূপে দেখা দিয়েছে। তাছাড়া, ইংরেজিতে যাঁদের আইকন বলে, বাঙালির কাছে তিনি তাই। বিদ্যাসাগরও রক্তমাংসের মানুষ, ভুল তো মানুষ মাত্রই হয়, তিনিও হয়ে তো ভুল করে ফেলেছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি তাঁর সম্পর্কে এধরনের আলফাল গল্প বলে পার পাওয়া যাবে না। বিদ্যাসাগর ভক্ত থেকে বিদ্যাসাগর গবেষক, সবাই স্বপক্ষে তথ্য প্রমাণ চাইবেনই এটা বলাই বাহুল্য।
প্রবাদপ্রতিম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সবাই রক্তমাংসের মানুষই। কিন্তু তাঁদের ভাব বিগ্রহ আজও লক্ষ লক্ষ বাঙালির হৃদয় মন্দিরে পূজিত। এঁদের কারও নামে বিরূপ মিথ্যাচার কিছু বললে সমাজে বিতর্ক সৃষ্টি হবেই। আর এটাই স্বাভাবিক। প্রসঙ্গত, বলতে হয় আধুনিক বাংলা ভাষার অন্যতম রূপকারকে এভাবে অকথ্য ভাষায় অসম্মান করা ও আধুনিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পিতৃপুরুষের মহান ঐতিহ্যকে এভাবে কালিমালিপ্ত করা হয়েছে একজন শিক্ষিকার বাক্যবাণে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্বামীজি, নেতাজি – বঙ্গজীবনে এই নাম গুলোই এক একটা ব্র্যান্ড। আদর্শ অনুসরণ ও অনুপ্রেরণার উৎস। আসলে মোদ্দা কথা হচ্ছে এই যে, মানুষ নিজের ঘরের ড্রইংরুমে, রকের আড্ডায়, চায়ের দোকানের ঠেকে, মজলিসের গুলতানিতে, দরজায় খিল দিয়ে স্বামী-স্ত্রী মিলে সারা জীবনে যত আজেবাজে, আলতুফালতু কথা বলে তার সবই যদি এই ফেসবুকে উগরে দিতে হয় তবে তো খুব মুস্কিল। তাই নয় কি ? তাছাড়া অধিকাংশ সাহিত্য বিদ্যজনেদের মত অনুসারে এখানে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে যৌনতা হল একটি ব্যক্তিগত বিষয়।
সেই সঙ্গে প্রেমজ যৌনতা বা সম্মতিসাপেক্ষ যৌনতা কখনই কোন প্রকার প্রশ্নচিহ্নের সামনে পড়ে না। এটা একটা যেমন বিষয়, ঠিক তেমনিই অন্যদিকে কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয় সম্পর্কিত কবি অধ্যাপিকার মন্তব্যটির কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে ব’লে মনে হয় না। তাই স্বাভাবিক ভাবেই ফেসবুকে উক্ত মন্তব্যকে ঘিরে আরম্ভ হয়েছে নিন্দা আর উচিত শাস্তির প্রতিবাদের ঝড়। জানা গিয়েছে, ইতিমধ্যেই সেই অধ্যাপিকা ও কবি সুতপা সেনগুপ্তকে বেশ কিছু বিদ্যজনের তরফ থেকে ওনার বক্তব্যের সমর্থনে উপযুক্ত প্রমাণ পেশ করতে বলা হয়েছে।
অন্যথায় বিষয় নিয়ে আন্দোলন আদালতের আঙ্গিনা পর্যন্ত যেতে হতে পারে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কিত কু-মন্তব্যের জেরে এই ফেসবুকে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণ দাখিল করার জন্য তাঁকে সাতদিন সময় দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় সেই কবি অধ্যাপিকার অপারগতা বৃহত্তর আন্দোলনের পথ সুপ্রশস্ত করবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। এদিকে ফেসবুকে শেয়ার করা সেই কবি অধ্যাপিকার উক্ত কুমন্তব্যকে ঘিরে সারা বিশ্বে ও দেশে তথা এই বাংলার বুকে ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে প্রতিবাদের ঝড়। তা কতদূর পর্যন্ত গড়ায় সেটা সময়ই বলবে।