বিনা চিকিৎসায় করোনা রোগীদের তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া, এটাই কি বাংলার কোভিড রোগীদের ভবিষ্যৎ? বেহাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দিকে আঙুল তুলছেন বিরোধীমহল
HnExpress ১৪ই জুলাই, নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা ঃ বিনা চিকিৎসায় করোনা রোগীদের তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া, এটাই কি বাংলার কোভিড রোগীদের ভবিষ্যৎ? বেহাল স্বাস্থ্যব্যবস্থার দিকে আঙুল তুলছেন বিরোধীমহল। প্রসঙ্গত, দিনে দিনে বাংলায় বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। করোনা রোগের উপসর্গ নিয়ে অনেকেই আসছেন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে।
কিন্তু স্বাস্থ্যদফতরের ওয়েবসাইটে খালি শয্যার পরিসংখ্যানের তথ্য দেওয়া থাকলেও রোগীদের খালি শয্যা নেই বলে ফিরিয়ে দিচ্ছেন ওয়েবসাইটে খালি শয্যার তালিকায় নাম থাকা অনেক সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতাল। ফলত রোগযন্ত্রনা সহ্য করতে করতে বহু শিশু থেকে বৃদ্ধ অকালেইভ ঢলে পড়ছেন মৃত্যুর কোলে।
ইন্টারনেটের দুনিয়ায় আমরা সবাই আধুনিক হয়েছি, কিন্তু মানবিক হতে পেরেছি কি আদৌ? রোগীরা কাঁদছেন, আর্তনাদ করছেন, তাদের সত্যিই কি দেখার কেউ আছে? ইচ্ছাপুরের নেতাজি পল্লীর উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়া শুভ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু বোধ হয় এই সমস্ত প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন আধুনিক সভ্য সমাজকে।
ইচ্ছাপুরের নেতাজি পল্লীর ১৮ বছরের স্থানীয় আনন্দমঠ স্কুলের উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়া শুভ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের শুক্রবার ভোরে প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত বাবা বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও গৃহবধূ মা শ্রাবনী চট্টোপাধ্যায়, একমাত্র ছেলেকে এই কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়ার আশায় দ্বারস্থ হন কামারহাটির ইএসআই হাসপাতালে। সেখানে তাঁর রক্ত পরীক্ষা করে জানানো হয় ৮০০-র ওপর সুগার।
তারপর থেকেই শুরু হয় হয়রানি। পাঠানো হয় তাঁকে কামারহাটির রথতলার কাছে মিডল্যান্ড নামক বেসরকারি হাসপাতালে। মৃতের বাবা মায়ের অভিযোগ, ওই হাসপাতালে রাস্তার ওপর ৮ ঘন্টার ওপর ফেলে রেখা হয়েছিল তাঁকে। মৃতের বাবার অনেক অনুরোধেও ভর্তি নেয়নি ওই হাসপাতাল। তারপর হাসপাতাল পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটি কিট দিয়ে টেস্ট করে হাতে লিখে দেয় কোভিড পজিটিভ। আবার পাঠিয়ে দেওয়া হয় সাগর দত্ত হাসপাতালে।
সাগর দত্ত হাসপাতাল অক্সিজেন ছাড়া চার ঘন্টা ফেলে রাখে শ্বাসকষ্ঠের ব্যাথায় নেতিয়ে পড়া ১৮ বছরের সেই যুবককে। তারপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে । সেখানেও বার বার সুপারের ঘর পর্যন্ত গিয়েও কোন কাজ না হওয়ায় মায়ের আত্মহত্যার হুমকির পর হাসপাতাল ভর্তি করতে চায় শুভ্রজিৎ-কে। অভিযোগ, ভর্তি করতে গেলে দেখতে পান তিনটি বেড খালি কিন্তু তাও ভর্তি নিচ্ছিল না মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।
রাত ৯টা ৪৫ নাগাদ মৃত্যু হয় শুভ্রজিৎ এর। মা শ্রাবনী চট্টোপাধ্যায় কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। তিনি জানান, হাসপাতালগুলোর গাফিলতিতেই তাঁর ছেলে আজ তাঁর কোল খালি করে চলে গেল। মৃতের বাবা জানান, রাত ৯টা ৪৫ নাগাদ মৃত্যু হলেও তাদের কোনরকম কিছু জানানোও হয়নি। সকাল বেলা এসে তারা জানতে পারেন যে তাঁর ছেলে আর নেই। বেলঘড়িয়া হাসপাতাল এর পাঁচ মিনিটে হাতে লেখা কোভিড পজিটিভ রিপোর্টের ভিত্তিতে মৃতদেহ দেখতে দিচ্ছেন না মেডিকেল কলেজ, এমনটাই অভিযোগ জানান মৃতের মা বাবা।
পাঁচ মিনিটে কি কোভিড টেস্ট হয়? কেন স্বাস্থ্য দফতরের শুভ্রজিৎ-র কোভিডে আক্রান্তের কোন নোটিশ নেই? কেন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কোন করোনা টেস্ট করলো না? প্রশ্ন তুলছেন উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়ার মা বাবা সহ বিরোধীদল। বাবা বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় কাঁদতে কাঁদতে বলেন, মেডিক্যাল কলেজ মৃতদেহ দেখতে দিচ্ছেন না, তাই তিনি মেডিকেল কলেজ সহ চারটি হাসপাতালে বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ জানিয়েছেন।
তিনি এদিন মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, মুখ্যমন্ত্রী বার বার বলেন হয়রানি করাবেন না, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর কথা শোনেনা কেউই, গ্রাহ্য করা হয় না নির্দেশকে। এই অমানবিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী মহল বিরোধিতায় সরব হয়েছেন। কংগ্রেস নেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী বলেন, অমিতাভ জি করোনায় আক্রান্ত হলে তাঁর দ্রুত আরোগ্য কামনায় টুইট করতে পারেন মুখ্যমন্ত্রীর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু এই ইচ্ছাপুরের ১৮ বছরের যুবকের মৃত্যুতে তিনি কেন নিশ্চুপ?
কিছু দিন আগেও তিনি বলেছিলেন কোভিড রোগীদের ফেরানো যাবে না, ফেরালে লাইসেন্স বাতিল করা হবে, কোথায় ৪৮ ঘন্টার বেশি হয়ে গেল লাইসেন্স কেন বাতিল করা হল না? প্রশ্ন তুলছেন তিনি। অন্যদিকে বামফ্রন্ট নেতা সুজন চক্রবর্তী জানান, এই মর্মান্তিক ঘটনায় তিনি যথেষ্ট ব্যথিত। তিনি আরও বলেন, কোন রোগী হাসপাতালে গেলেই বলা হচ্ছে করোনা টেস্ট করতে হবে আগে, কিন্তু করোনা টেস্টের কোন সঠিক নির্দেশিকাই নেই।
অথচ হ্যাল্পলাইনে ফোন করলে ফোন ধরার কেউ নেই, বেহাল স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা, কেন বেঁধে দেওয়া হচ্ছে না বেসরকারি হাসপাতালগুলির চিকিৎসা ব্যাবস্থা?এমনটাই বলছেন তিনি।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, প্রতিদিন এইরকম অমানবিক ঘটনা ঘটছে। তিনি আরও বলেন, এক চিকিৎসকের বাবা বেড পারছেন না, প্রতিদিন রোগীদের ফেরানোর হচ্ছে আর খালি বেডের তালিকা দিয়েও অসামঞ্জস্যতা দেখা দিচ্ছে বাস্তবে। কথার খেলাফ করছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, এমনটাই বলছেন তিনি।
প্রভাবশালী ব্যক্তিরা করোনায় আক্রান্ত হলে সুস্থতার জন্য সকলেই যজ্ঞ করছেন, কিন্তু এই উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়ার শ্বাসকষ্ঠের ব্যাথায় কোন চিকিৎসকরা মানবিকতার ভিত্তিতে চিকিৎসার জন্য এগিয়ে এলেন না, কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের সভ্য সমাজের মানবিকতা? আবার আজকাল মা বাবার আত্মহত্যার হুমকিতে যেখানে রোগীদের হাসপাতাল ভর্তি নিতে হয়, সেখানে স্বাস্থ্যব্যবস্থা আজ কোথায় দাঁড়িয়ে ?
অন্যদিকে খালি শয্যা থাকলেও কেন রোগীকে ভর্তি না করে হয়রানির মুখে দাঁড় করিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বারংবার? এমনই নানা প্রশ্ন তুলে বাংলার বেহাল স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে মানুষের কাঠগড়ায় দাঁড় করাছেন বিরোধী মহলের একাংশ।