করোনার কোপে কাটছাঁট আন্দুল-মৌড়ির ঐতিহ্যের রাসমেলায়

0


HnExpress সৌম্যজিৎ চক্রবর্তী, হাওড়া ঃ করোনা আবহে এবারও ছেদ পড়লো আন্দুল-মৌড়ির ঐতিহ্যবাহী রাসমেলার আয়োজনে। রাসপূজা হলেও গতবছরের মতো এ’বছরেও মেলা বসেনি মৌড়ির রাসমাঠে। জানা যায়, আগে একটিই রাস উৎসব হত মৌড়ির জমিদার কুন্ডু চৌধুরীদের উদ্যোগে। তবে পরবর্তীকালে স্থানীয় সংগঠন মহীয়াড়ি ফুলবাগান স্পোর্টিং ক্লাবের হাত ধরে এই রাসমেলা শুরু হয়।

ইতিহাস বলছে, প্রায় ২০০ বছরেরও আগে ১৮১৬-য় রমাকান্ত কুন্ডুচৌধুরীর হাত ধরে গোড়াপত্তন হয়েছিল মৌড়ির রাসের। সাতটি গ্রামের ব্রাহ্মণকে দিয়ে এই পুজোর শুরু। কিন্তু টিম টিম করতে করতে আজ তা ঠেকেছে একজনে। অপরদিকে গত সাড়ে ৩ দশক থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত রাসের রাশ নিজেদের হাতে নিয়ে বাণিজ্যিক মেলার বহর অনেকটাই বাড়িয়ে নিয়েছিল ফুলবাগান ক্লাব।

জানা যায়, জমিদার কুন্ডুচৌধুরীদের আদি বাস মেদিনীপুরের তমলুকে। ১৭৭০-এ পূর্বপুরুষ কুশদেবের বংশধররা শুরু করেন ঝাঁটার কাঠি আর নুনের ব্যবসা। সেই সূত্রেই আন্দুল-মৌড়িতে আসা। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি মন্দির ও তার সংলগ্ন জমিদার বাড়ি তৈরি হয়। দুর্গাদালানেই কূলদেবতা লক্ষ্মী জনার্দনকে ঘিরেই রাসমঞ্চ।

কুন্ডুচৌধুরী পরিবারের বরিষ্ঠ সদস্যের থেকে জানা যায়, সে সময়ে সরস্বতী নদী দিয়ে নৌকায় চড়ে আসতেন নাজিরের দল। আর রাজশাহী থেকে সানাইবাদকেরা। রাস শুরুর সপ্তাহখানেক আগে থেকে আসত কীর্তনীয়ার দল। গরুর গাড়িতে করে আসতো রাস ফুলের গাছ ও শোলার তাড়ি। আর সোনার পালকিতে করে আনা হতো লক্ষ্মী জনার্দনকে। রাসপূর্ণিমা থেকে টানা তিন দিন চলতো এই পুজো।

প্রতিদিন বিগ্রহকে দেওয়া হতো প্রায় ৪৫ মন চালের নৈবেদ্য। অতিথি আপ্যায়নের জন্য থাকতো হাতে গড়া হরেকরকম মিষ্টি। আর মেলা হতো মাসব্যাপী। স্থানীয় প্রবীণদের থেকে শোনা যায়, ১০০ বছরের কিছু আগেও বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে এই সময় রাসের জন্য একমাস বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করতো। এও জানা যায়, এই রাস দেখতে আসতেন আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, সি ভি রমন, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ। একটা সময় ছিল স্বয়ংক্রিয় মাটির পুতুলে দেখানো হতো ঝাঁকি (শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা)।

কখনওবা রামায়ণ, মহাভারত বা পুরাণের বিভিন্ন অধ্যায়। কখনও আবার অর্জুনকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ব্যাখ্যা। হ্যাজাক আর গ্যাসের আলোয় হতো যাত্রাপালা, নাটক। বসতো তরজা, ভাদু গানের আসর। শোনা যায়, এই রাসমেলায় হওয়া যাত্রা, নাটক এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে, নাট্যব্যক্তিত্ব অতীন্দ্র চৌধুরী, জহর গাঙ্গুলী, ছবি বিশ্বাসও অভিনয় করেছেন এখানে। পাশাপাশি কখনও হতো পুতুল নাচ, ম্যাজিক প্রদর্শনীও। কিন্তু তা ওই ঠাকুরদালান আর রাসমাঠ চত্বরেই।

যদিও এখন যাত্রা, নাটক না হলেও মাটির পুতুলে পৌরাণিক ব্যাখ্যার চল রয়ে গেছে কুন্ডুচৌধুরী পরিবারের রাসে। আর ক্লাবের হাত ধরে যে বাণিজ্যিক মেলার বিস্তার হয়েছিল তা ২০১৯ সাল পর্যন্ত রাসমাঠ ছাড়িয়ে তা বসতো একদিকে মৌড়ি স্কুল, অন্যদিকে রথতলার রাস্তার দু’পাশেও। কিন্তু করোনার কারণে ২০২০-র মতো এ’বছরেও ছেদ পড়লো সেই মেলা আয়োজনের ট্র্যাডিশনে।

FacebookTwitterShare

Leave a Reply Cancel reply