শাসক দলের ক্ষোভ-অসন্তোষ সামাল দিতে এবারে উত্তরবঙ্গের সফরে খোদ তৃণমূল সুপ্রিমো
HnExpress ১৪ই ডিসেম্বর, অরুণ কুমার, শিলিগুড়ি ঃ শাসক দলের ক্ষোভ অসন্তোষ সামাল দিতে উত্তরবঙ্গের সফরে এবারে খোদ তৃণমূল সুপ্রিমো। উত্তরবঙ্গ সফর শুরু করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। সোমবার থেকেই মূলত ডুয়ার্সের জেলায় তিনি রাজনৈতিক সভা করবেন। এছাড়া বেশ কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বৈঠক করার কথাও রয়েছে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের। গত সপ্তাহেই তিনি উত্তরকন্যা অভিযান করে বিজেপি।
অভিযোগ যে, সেই অভিযানে গুলিতে মৃত্যু হয় তাঁদের কর্মী উলেন রায়ের। এরপরেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে শিলিগুড়ি সহ উত্তরবঙ্গের গোটা রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এরপর বিজেপির ডাকা বনধে শিলিগুড়িতে মুখ্যমন্ত্রীর ফ্লেক্স ছেঁড়ার অভিযোগও করা হয়। ফলে অভিযোগ আর পালটা অভিযোগে সরগরম হয়ে আছে পুরো উত্তরবঙ্গ। তারই মধ্যে রাজনৈতিক সভা করতে যাচ্ছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দোপাধ্যায়। মঙ্গলবার জলপাইগুড়িতে একটি রাজনৈতিক সভায় বক্তব্য রাখবেন মমতা। এরপর বুধবার তিনি থাকবেন কোচবিহারে। তিনদিনের সফরে উত্তরবঙ্গে জুড়ে একাধিক রাজনৈতিক জনসভা রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর। একইসঙ্গে সোমবার বিকেলে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করার কথা রয়েছে তাঁর।
কিছুদিন আগেই প্রশাসনিক বৈঠকে যোগ দিতে উত্তরবঙ্গে এসেছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কোভিড বিধি মেনে উত্তরকন্যায় উত্তরের ৫ জেলা নিয়ে তিনি প্রশাসনিক বৈঠক করেন। জেলায় জেলায় সরকারি কাজ কতদূর এগোলো, উত্তরের জেলাগুলির কেমন অবস্থা, তা খতিয়ে দেখা এবং পর্যালোচনা করা সেই সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল। কোভিড পরিস্থিতির আগে মালদহ, মুর্শিদাবাদ, রায়গঞ্জ, বালুরঘাটও সফর করেন মুখ্যমন্ত্রী। করোনা পরিস্থিতিতে জেলা সফর করেননি তিনি।
তবে সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, মঙ্গলবার জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার, দুই জেলাকে নিয়ে জলপাইগুড়িতে একটি রাজনৈতিক সভায় বক্তব্য রাখবেন তৃণমূল সুপ্রিমো। এরপর বুধবার তিনি থাকবেন কোচবিহারে। সেখানে রাসমেলা ময়দানে তাঁর একটি রাজনৈতিক জনসভাও রয়েছে। উল্লেখ্য যে, কিছুদিন আগেই দল ছেড়েছেন কোচবিহার জেলার বিধায়ক মিহির গোস্বামী। মুখ্যমন্ত্রী উত্তরবঙ্গে আগমনের আগেই বেশ কিছু বিষয় দেখা দিয়েছে, যা দলের শীর্ষ নেতাদের কাছে অস্বস্তি আর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজ্য রাজনীতিতে ইতিমধ্যেই দুই প্রভাবশালী নেতা শুভেন্দু অধিকারী, শিলভদ্র দত্তের পর
রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের যত মত তত পথ’কে ঘিরে শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা। যার প্রভাব এসে আছড়ে পড়েছে উত্তরবঙ্গের রাজনীতির অঙ্গনে। তার আগে দল ছেড়েছেন, তৃণমূল সুপ্রিমোর অত্যন্ত কাছের লোক বলে পরিচিত মিহির গোস্বামী। এরপরই আরেক তৃণমূল বিধায়ক দিনহাটার উদয়ন গুহ হালকা আভাস দিয়েছেন “যত মত তত পথ”কে প্রচ্ছন্ন সমর্থন প্রকাশ করে।
তার আগে অবশ্য তিনি প্রকাশ্য সভায় বলেছেন বিজেপিতে যাওয়ার জন্য তার কাছে অনেকবার অফার এসেছে। এর সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে ময়নাগুড়ির আরেক বিধায়ক অনন্ত দেব অধিকারীর নামও। আরও একজন রয়েছেন সত্যেন্দ্রনাথ দাস, তিনি হেমতাবাদের তৃণমূল বিধায়ক। রয়েছেন ইসলামপুরের পুরনো তৃণমূল নেতা। এসব মিলিয়ে অস্বস্তি ও দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে উত্তরবঙ্গের নেতাদের। মুখ্যমন্ত্রী আসার আগেই এবার ময়নাগুড়ির তৃণমূল বিধায়ক অনন্তদেব অধিকারীও দলীয় কর্মসূচিতে প্রশান্ত কিশোরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
এর পাশাপাশি দলের এই নতুন ব্যবস্থা সম্পর্কে তার বিস্ফোরক মন্তব্য, এতদিন ধরে ভোটের কাজ করছেন তিনি। এবার প্রশান্ত কিশোরের কাছ থেকে তিনি ভোটের কাজকর্ম শিখতে চান না। শুধু তাই নয়, প্রশান্ত কিশোরের কর্মকাণ্ডের সার্থকতা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। তিনি জানান পিকের টিমের ওপর আমার যথেষ্ট ব্যক্তিগত ক্ষোভ রয়েছে। তারা যেভাবে প্রোগ্রাম সিলেকশন করছেন এবং সেটা আমাদের সাথে কোনরকম আলোচনা না করেই, আমরা যেন তাঁর চাকর-বাকরের মত ব্যবহার দেখতে পাচ্ছি।
তবে তিনি এটাও জানিয়েছেন যে, প্রশান্ত কিশোরের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে, কিন্তু তৃণমূল দলের কোনো সদস্যের সঙ্গে তার কার্যত কোনো কথা হয়নি। উল্লেখ্য, দলে প্রশান্ত কিশোরের প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তৃণমূল বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারীও। বর্তমানে দলের সঙ্গে তার দূরত্ব স্পষ্ট। এরপর একে একে শীলভদ্র দত্ত, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, অনন্তদেব অধিকারীও তৃণমূল দলের বিরুদ্ধে সেই একই অভিযোগ তুললেন। তৃণমূল দলের অভ্যন্তরে প্রশান্ত কিশোরের প্রভাব বিস্তার নিয়ে দলীয় নেতা, কর্মীদের ক্ষোভ-অসন্তোষ ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
এ বিষয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের উত্তরবঙ্গ কোর কমিটির দায়িত্ব প্রাপ্ত চেয়ারম্যান মন্ত্রী গৌতম দেবকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান, দলের বিধায়ক হিসেবে তিনি মিডিয়ার কাছে যা বলেছেন সেটা ঠিক নয়। এগুলো নিয়ে আমরা দলের মধ্যে আলোচনা করতে পারি, এ বিষয়ে আমি মিডিয়ার কাছে কিছু বলবো না। এই বলে তিনি এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান। এদিকে সবচেয়ে বড় আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক মহলে তা হল, ময়নাগুড়িতে শুভেন্দু অধিকারীর সমর্থনে ফ্লেক্স। সেই সঙ্গে বিধায়ক অনন্তদেব অধিকারী বেসুরো গাইতেই তাঁর কেন্দ্রের বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেল দাদার অনুগামীদের ফ্লেক্স।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এখন দাদাকে, দাদার অনুগামী কারা তা সকলেরই জানা। শুভেন্দু অধিকারীর ছবি সংবলিত কোনও ফ্লেক্সে লেখা, ‘লড়াইয়ের মাঠে দেখা হবে।’ প্রত্যেকটি ফ্লেক্সের নিচে লেখা, ‘আমরা দাদার অনুগামী /ময়নাগুড়ি বিধানসভা।’ এভাবেই একাধিক প্রশ্ন উত্তরবঙ্গের রাজনৈতিক মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে তা হল, বিধায়ক অনন্তদেব অধিকারীও কি তৃণমূলের বিক্ষুব্ধদের দলে নাম লেখালেন ? অনন্তদেব মিডিয়ায় পিকের বিরুদ্ধে মুখ খুলতেই তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে এই জল্পনা শুরু হয়ে গেছে ।
ময়নাগুড়িতে দাদার অনুগামীদের ফ্লেক্স পড়তে না পড়তেই জল্পনা আরও জোরদার হয়েছে। জলপাইগুড়ি জেলায় শুভেন্দু অধিকারীর সব থেকে বড় সেনাপতি বুবাই কর। তিনি এখনও তৃণমূলের জলপাইগুড়ি জেলা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর যাবতীয় রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুভেন্দু অধিকারীর ইঙ্গিতেই চলছে বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা। ময়নাগুড়িতে দাদার অনুগামীদের ফ্লেক্স পড়ার ঘটনায় জিজ্ঞাসা করা হলে বুবাইয়ের সাফ জবাব, ‘তিনি দাদার অনুগামী এবং দাদার অনুগামীরাই সারা জেলা জুড়ে দাদার ফ্লেক্স লাগাচ্ছেন। ময়নাগুড়িতেও তাঁরাই ফ্লেক্স লাগিয়েছেন।’
অপরদিকে, তৃণমূল সুপ্রিমো এ বিষয়ে সমস্ত খবরাখবর নবান্ন থেকে শুরু করে প্রতিটি জেলার বিভিন্ন অবস্থা নিয়ে খোঁজ নিয়েছেন। তিনি নির্দেশ দিয়ে ছিলেন, জেলাশাসকরা যেন জরুরি বৈঠক সেরে প্রয়োজনীয় বিষয় গুলিতে হস্তক্ষেপ করেন। মুখ্যমন্ত্রী আগেই জানিয়ে ছিলেন, সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে তিনি ফের জেলা সফর শুরু করবেন। আর মুখ্যমন্ত্রীর সেই সফর শুরু হয়েছিল উত্তরবঙ্গ দিয়ে। মুখ্যমন্ত্রীর সফর নিয়ে আগ্রহ রয়েছে রাজনৈতিক মহলেও। লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরে একাধিকবার তিনি উত্তরের বিভিন্ন জেলায় ছুটে গিয়েছেন। আগামী বছর নির্বাচন রাজ্যে।
তার আগে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল সাংগঠনিক দিক থেকে কোমর বেঁধে নেমে পড়ার চেষ্টা করছে। এই অবস্থায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সফর তাঁর দলের কর্মীদের অনেকটাই চাঙ্গা করবে বলে আশা করা যায়। আর বিশেষ করে কোচবিহার জেলার যেখানে একাধিক অভিযোগ আসে। এছাড়া উত্তরের একাধিক জায়গায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিয়েও নানা সমস্যা তৈরি হয়েছে। তবে লোকসভা নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, উত্তরের জেলায় ভাল ফল করেছে বিজেপি। বিধানসভা ভোটের আগে নিজেদের হারানো জমি পুনরুদ্ধারে কাজে তাই এবারে কোমড় বেঁধে নেমে পড়তে চলেছে তৃণমূল কংগ্রেস।