October 11, 2024

২১ শে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবসের ইতিকথা

0
Advertisements

HnExpress বিশেষ প্রতিবেদন : বাংলা ভাষার জন্য এক দারুণ ব্যাপার ঘটল সেদিন। দিনটি ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ইউনেসকোর ৩০ তম অধিবেশন বসে। ইউনেসকোর সেই সভায় ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব পাস হয়। ফলে পৃথিবীর সব ভাষাভাষীর কাছে একটি উল্লেখযোগ্য দিন হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারি স্বীকৃতি পায়। বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষা লাভ করে বিশেষ মর্যাদা। ঠিক পরের বছর ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে পৃথিবীর ১৮৮টি দেশে এ দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন শুরু হয়।

২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পেছনের ঘটনা জানতে হলে আমাদের একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। আমরা জানি, একুশে ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা আন্দোলনের দিন। প্রতিবছরই মর্যাদার সঙ্গে বাংলাদেশসহ বিশ্বে অনেক দেশে দিনটি পালিত হয়ে আসছে। এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা রাজ্যে ‘বাংলা ভাষা দিবস’ হিসেবেও পালিত হয়ে আসছে এই দিনটি।

২১ শে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করার আগে, এই দিনটি মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে দাবি শোনা যায়, বিভিন্ন সামাজিক -সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও এ দাবি তোলা হয়। এ রকম আরও কিছু ব্যক্তিগত ও বিচ্ছিন্ন উদ্যোগের কথা আমরা জানতে পারি। তবে এ বিষয়ে প্রথম সফল উদ্যোক্তারা হলেন কানাডার বহুভাষিক ও বহুজাতিক মাতৃভাষা-প্রেমিকগোষ্ঠী। এই গোষ্ঠী প্রথমে ১৯৯৮ সালের ২৯ মার্চ জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ নামে একটি দিবস ঘোষণার প্রস্তাব উপস্থাপন করে। সেখানে তাঁরা বলেন, ‘বাঙালিরা তাদের মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সেটা ছিল তাদের ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। আজকের পৃথিবীতেও অনেক জাতি-গোষ্ঠীর ভাষাও একই সমস্যা ও বিপদের মধ্যে আছে।’ কাজেই মাতৃভাষা দিবসের দাবিটি খুবই ন্যায়সংগত।

মাতৃভাষা-প্রেমিকগোষ্ঠীর এই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন সাত জাতি ও সাত ভাষার ১০ জন সদস্য। তাঁরা হলেন অ্যালবার্ট ভিনজন ও কারমেন ক্রিস্টোবাল (ফিলিপিনো), জ্যাসন মোরিন ও সুসান হজিন্স (ইংরেজি), ড. কেলভিন চাও (ক্যান্টনিজ), নাজনীন ইসলাম (কা-চি), রেনাটে মার্টিনস (জার্মান), করুণা জোসি (হিন্দি) এবং রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম (বাংলা)। জাতিসংঘ মহাসচিবের অফিস থেকে এই পত্রপ্রেরকদের জানিয়ে দেওয়া হয়; বিষয়টির জন্য নিউইয়র্কে নয়, যোগাযোগ করতে হবে প্যারিসে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি-বিষয়ক সংগঠন ইউনেসকোর সঙ্গে। জাতিসংঘের কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তা হাসান ফেরদৌসেরও এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা ছিল সে সময়।

এরপর প্রায় এক বছর পেরিয়ে যায়। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি ইউনেসকো। কানাডা প্রবাসী বাঙালি আবদুস সালাম ও রফিকুল ইসলাম (যাঁরা মাতৃভাষা-প্রেমিকগোষ্ঠীর সদস্য) এ বিষয়ে ইউনেসকোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেন। প্রথমে টেলিফোনে এবং পরে চিঠিতে। ১৯৯৯ সালের ৩ মার্চ ইউনেসকো সদর দপ্তরের ভাষা বিভাগের কর্মকর্তা আন্না মারিয়া মেজলোককে রফিকুল ইসলাম একটি চিঠিতে জানান যে ‘২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার তোমাদের অনুরোধটি বেশ আকর্ষণীয় মনে হয়েছে।’

কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার একজন কর্মকর্তার কাছে এই প্রথম বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। আন্না মারিয়া আরও জানান, ‘বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে উত্থাপনের কোনো সুযোগ নেই, ইউনেসকোর পরিচালনা পরিষদের কোনো সদস্য রাষ্ট্রের মাধ্যমে সভায় এটি তুলে হবে।’ ইউনেসকো সদর দপ্তরের ভাষা বিভাগের কর্মকর্তা মারিয়া রফিকুল ইসলামকে ইউনেসকো পরিচালনা পরিষদের কয়েকটি সদস্য দেশের ঠিকানাও পাঠিয়ে দেন। এতে বাংলাদেশ, ভারত, কানাডা, ফিনল্যান্ড এবং হাঙ্গেরির নাম ছিল। ইউনেসকো সাধারণ পরিষদে বিষয়টি আলোচ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হলে কয়েকটি সদস্য দেশের পক্ষে প্রস্তাব পেশ করা জরুরি। তখন হাতে সময় ছিল খুবই কম। কেননা অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই সাধারণ পরিষদের সভা বসবে।

কানাডা থেকে রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিষয়টি রাষ্ট্রের জন্য গর্বের বিষয় মনে করে মন্ত্রণালয় অতি দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর অফিসে অনুমতি চেয়ে নোট পাঠায়। বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সময়স্বল্পতার বিষয়টি উপলব্ধি করেন। তিনি সব ধবনের জটিলতা উপেক্ষা করে নথি অনুমোদনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া ছাড়াই ইউনেসকোর সদর দপ্তরে প্রস্তাবটি পাঠিয়ে দেন সরাসরি। ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ সালে সংক্ষেপে বাংলাদেশ জাতীয় ইউনেসকো কমিশনের পক্ষে এর সচিব অধ্যাপক কফিলউদ্দিন আহমদের স্বাক্ষরিত সেই প্রস্তাবটি প্যারিসে পৌঁছে যায়।

তখন ইউনেসকোর নির্বাহী পরিষদের ১৫৭তম অধিবেশন এবং ৩০তম সাধারণ সম্মেলন ছিল। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের বিষয়টি নিয়ে ইউনেসকোতে দুটি সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমত, ইউনেসকো ভেবেছিল, এমন একটা দিবস পালন করতে গেলে ইউনেসকোর বড় অঙ্কের টাকাপয়সা প্রয়োজন হবে। প্রতিবছর অনেক টাকাপয়সা খরচের কথা ভেবে প্রথমেই প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। একই সঙ্গে ইউনেসকো মহাপরিচালক International Mother Language Day নয়, International Mother Tonguae Day নামে একে অভিহিত করতে সচেষ্ট হন। মহাপরিচালক এ জন্য এক লাখ ডলারের ব্যয় বরাদ্দের প্রস্তাব করেন এবং দুই বছর পর নির্বাহী পরিষদের ১৬০তম অধিবেশনে একটি সম্ভাব্যতা জরিপের মাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরার আদেশ দেন।

এর ফলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার বিষয়টি আটকা পড়ে। প্রস্তাবটি কার্যকর হতে কমপক্ষে দুই বছর সময় লাগবে বলে মনে করা হয়। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী এ এস এইচ কে সাদেক। শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন ইউনেসকো অধিবেশনে যোগদানকারী বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতা। তিনি অধিবেশনে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, যেখানে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও তাৎপর্য পৃথিবীর ১৮৮টি জাতির সামনে তুলে ধরেন। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন দেশের শিক্ষামন্ত্রীদের সঙ্গে ঘরোয়া বৈঠক করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের পক্ষে অভিমতও গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন। এমনকি উপস্থিত সদস্যদের বোঝাতে সক্ষম হন, দিবসটি পালন করতে প্রকৃতপক্ষে ইউনেসকোর এক ডলারও লাগবে না। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ নিজেরাই নিজেদের মাতৃভাষার গুরুত্ব আলোচনা ও জয়গান গাইতে গাইতে দিনটি পালন করবে।

এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার ডকুমেন্টেশন পুস্তিকায় সদস্যসচিব ড. মোহাম্মদ হাননান লিখেছেন, ‘শিক্ষামন্ত্রী এ এস এইচ কে সাদেক একই সঙ্গে কতকগুলো ব্যক্তিগত কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও চালান। এক রাতে তিনি পাকিস্তানি প্রতিনিধিদের নেতার সঙ্গেও একটি বৈঠকের আয়োজন করেন। প্রস্তাবটিতে পাকিস্তানের সমর্থন প্রয়োজন ছিল। কারণ, যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রশ্ন ঘিরে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সংঘটিত হয়েছিল, তাতে পাকিস্তানের মনোভাবে অবশ্যই না-বাচক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা ছিল। এ ছাড়া অন্যান্য মুসলিম দেশ, বিশেষ করে সৌদি আরবের সমর্থনের ক্ষেত্রেও সে দেশের ইতিবাচক ভূমিকা প্রভাব ফেলতে পারত। ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানে সামরিক সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। ফলে পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী সে বছর ইউনেসকো সম্মেলনে যাননি, পাকিস্তানি দলের নেতৃত্ব দেন পাকিস্তানের শিক্ষাসচিব। বৈঠকে এ এস এইচ কে সাদেক আবিষ্কার করেন, পাকিস্তানের শিক্ষাসচিব একসময় তাঁর অধীনে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে কাজ করেছেন। আরও মজার বিষয়, পাকিস্তানের শিক্ষাসচিব বাংলায় চমৎকার কথা বলতে পারেন। ফলে এ বৈঠক খুবই সফল হলো। তিনি প্রস্তাবটি সমর্থনের আশ্বাস দেন। …ইউরোপীয় দেশগুলোকে নিয়েও কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণায় তাদের আপত্তি ছিল না। তবে তারা ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। পাশ্চাত্য দেশগুলোর কাছে শিক্ষামন্ত্রী যুক্তি ও আবেগের সঙ্গে এই বিষয়টি তুলে ধরেন যে পৃথিবীতে বাঙালিরা মাতৃভাষার অধিকারের জন্য রক্ত দিয়েছে। সেটা ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে। তখন ইউরোপীয়রা ব্যাপারটা বুঝতে পারে।’

এভাবে দীর্ঘ প্রক্রিয়া পার হওয়ার পর ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১ ফেব্রুয়ারি লাভ করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা। ইউনেসকোর ঐতিহাসিক সেই অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের মূল প্রস্তাবক ছিল বাংলাদেশ এবং সৌদি আরব। আর সমর্থন করেছিল আইভরি কোস্ট, ইতালি, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, কমোরোস, ডোমিনিকান রিপাবলিক, পাকিস্তান, ওমান, পাপুয়া নিউগিনি, ফিলিপিন, বাহামাস, বেনিন, বেলারুশ, গাম্বিয়া, ভারত, ভানুয়াতু, মাইক্রোনেসিয়া, রুশ ফেডারেশন, লিথুয়ানিয়া, মিসর, শ্রীলংকা, সিরিয়া ও হন্ডুরাস।

১৯৯৯ সালে একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা লাভ শুধু বাংলা ভাষার বিশ্ববিজয় নয়; পৃথিবীর সব মাতৃভাষার জয়।

তথ্যসুত্রঃ ইন্টারনেট।

Advertisements

Leave a Reply