ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচানোর জন্য তামাক মুক্ত পশ্চিমবঙ্গ গড়তে হলে দরকার সমাজ সচেতনতা ও তামাক উৎপাদন বন্ধ করা
HnExpress ইন্দ্রানী সেনগুপ্ত, কলকাতা ঃ পশ্চিমবঙ্গে ২.৩ কোটি মানুষ ধোঁয়াযুক্ত বা ধোঁয়াহীন তামাক ব্যবহার করেন। তামাক সংক্রান্ত রোগের কারণে প্রতি বছর সম্পূর্ণ জীবনসীমা পার করবার আগেই মারা যান প্রায় ১.৫ লক্ষ মানুষ। তাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচানোর জন্য পশ্চিমবঙ্গকে ‘তামাক মুক্ত’ করা প্রয়োজন সবার আগে। হ্যাঁ এমনই এক চাঞ্চল্যকর তথ্যকে সামনে রেখে এই মহৎ উদ্দেশ্যকে সফল করতে সম্বন্ধ হেলথ্ ফাউন্ডেশন, হাওড়ার নারায়ণা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল ও উইন্ডোজ ফিল্ম প্রোডাকশন হাউসের যৌথ উদ্যোগে কলকাতা প্রেসক্লাবে আজ অনুষ্ঠিত হল একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিক সম্মেলন।
এদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা নন্দিতা রায়, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নারায়ণা হাসপাতালের সিনিয়র হেড ও নেক সার্জেন সৌরভ দত্ত, হাসপাতালের পূর্বাঞ্চলীয় ডিরেক্টর আর ভেঙ্কটেশ, ডাঃ হর্ষ ধর প্রমুখ। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিবৃন্দ ও বিশেষজ্ঞরা এই ব্যাপারে তাঁদের উদ্বেগ প্রকাশ করে বললেন যে, “জর্দা, খৈনি, গুটখার মতো ক্ষতিকারক ধোঁয়াহীন তামাক পদার্থ এবং সিগারেট ও বিড়ির মতো ধোঁয়াযুক্ত তামাকের ব্যবহার পশ্চিমবঙ্গে কোনমতেই হ্রাস পাচ্ছে না। তাই পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচানোর জন্য পশ্চিমবঙ্গকে তামাক মুক্ত করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।” তাই তাদের বক্তব্য অনুযায়ী এটাই সমাজের কাছে তাদের বিনীত আবেদন, আর তাই এর জন্য প্রয়োজন যথেষ্ট পরিমাণে জনসংযোগ, সামাজিক চেতনাবৃদ্ধি, বর্তমান আইনানুযায়ী মেনে স্কুল-কলেজের আশেপাশে তামাকজাত পণ্য বা দ্রব্যাদি ব্যাতিরেকে দোকান-পসারি, বাসে-ট্রেনে বা জনবহুল এলাকায় ধূমপান থেকে বিরত থাকা, বাড়িতে বা অফিসে ধূমপান থেকে বিরত থাকা এবং সর্বোপরি বেশি দরকার বর্তমান সরকারের এব্যাপারে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এগিয়ে আসা এবং অবিলম্বে রাজ্যে এমন কোন আইন আনয়ন করা যাতে করে তামাকজাত পণ্য বা দ্রব্য তৈরির কারখানা গুলি সমূলে বন্ধ করা হয়।
কারণ তাদের মতানুযায়ী এই ধরনের কল কারখানা গুলির সাথে একাংশ রাজনৈতিক দল জরিত এবং এমন বহু রাজনৈতিক নেতা মন্ত্রী আছেন, যাদের তামাকজাত দ্রব্য এর এমন বহু কারখানা রয়েছে, যে গুলি একটি নির্দিষ্ট ও কঠোর আইন আনয়ন করে শীঘ্রই বন্ধ করা অতি আবশ্যক। নচেৎ আমরা যতই নানাভাবে সমাজকে সচেতন করতে নানান ধরনের সচেতনতা সম্বন্ধীয় উদ্যোগ বা এ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম করি না কেন, সমাজ থেকে বিশেষ করে নব প্রজন্মকে তামাক নামক বিষ সেবন থেকে বিরত করা যাবে না, আর না এই সাধের বাংলাকে ও যুব সমাজকে তামাকজাত দ্রব্য সেবন থেকে উৎপন্ন ক্যান্সার নামক মারণ রোগের হাত থেকে মুক্ত করা সম্ভবপর হবে।
অন্যদিকে এই নিয়ে শিবপ্রসাদ মুখার্জী বললেন, “নন্দিতা রায় এবং আমি, দায়িত্ববান মানুষ হিসেবে সবসময়েই অনুভব করেছি যে আমাদের কাজে সবসময় একটি বার্তা থাকা উচিত, যা মানুষের জীবনকে উন্নতির দিকে চালিত করে। চলচ্চিত্র যেহেতু অনেক মানুষকে স্পর্শ করে, আমরা আমাদের আসন্ন একটি চলচ্চিত্র ‘কন্ঠ‘ কে তামাক ব্যবহারের বিরুদ্ধে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি। আমরা স্কুল শিক্ষা বিভাগের প্রশংসা করি তামাক বিরোধী প্রচার কার্যে উইন্ডোজ ফিল্ম প্রোডাকশন, নারায়ণা হাসপাতাল ও সম্বন্ধ হেলথ ফাউন্ডেশন এর সঙ্গে সহযোগিতার জন্য।“
এর আগেও, স্কুল শিক্ষা বিভাগ থেকে রাজ্যে তামাক বিরোধী প্রচারাভিযান শুরু করা হয়েছিল। রাজ্যের প্রায় দশ হাজার সরকারি স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা নিয়েছিল তামাক বিরোধী অঙ্গীকার। রাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বিধাননগর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই তামাক বিরোধী উদ্যোগ চালু করেছিলেন। ২০১৯ সালের ২রা জানুয়ারির ওই অনুষ্ঠানে পার্থ চট্টোপাধ্যায় ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন নন্দিতা রায়, শিবপ্রসাদ মুখার্জী এবং নারায়ণা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের চিকিৎসকগণ ও কর্মকর্তারা।
তিনি আরও বললেন যে, গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোবাকো সার্ভে (২০১৬-১৭) এর তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে ১৫ বছরের বেশি বয়স্কদের মধ্যে ৩৩.৫ শতাংশ মানুষ, যা কিনা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২.৩ কোটি, যে কোনও মাধ্যমে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করে। এর মধ্যে ৪৮.৫% পুরুষ ও ১৭.৯% মহিলা। এর মধ্যে ধোঁয়াযুক্ত তামাক ব্যবহার করেন ১৬.৭% মানুষ (৩১.৭% পুরুষ, ০.৯% মহিলা) ও ধোঁয়াহীন তামাক ব্যবহার করেন ২০.১% (২২.৮% পুরুষ, ১৭.২% মহিলা)। এই সমীক্ষা থেকে এও দেখা যাচ্ছে যে, পাবলিক প্লেস বা জন বহুল স্থানে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন ২২.৫% মানুষ। বাড়িতে বা ঘরের ভিতরে পরোক্ষ ধূমপানের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন ৫৬.১% মানুষ এবং কর্মক্ষেত্রে আক্রান্ত হচ্ছেন ৫৭.৫% মানুষ। অর্থাৎ যারা সেবন করছে তাদের থেকেও বেশি পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যারা সেবন করেন না, কিন্তু প্রতিনিয়ত নিশ্বাসের দ্বারা অক্সিজেনের পরিবর্তে এই ক্ষতিকারক ধোঁয়া প্রতিনিয়ত গ্রহণ করতে রীতিমতো বাধ্য হচ্ছেন। তবে বিড়ি (১৪.৪%) সবথেকে বেশি ব্যবহৃত তামাকজাত দ্রব্য। পশ্চিমবঙ্গে বিড়ি সেবনকারীরা খরচা করেন মাসে প্রায় ৩৯০.৫০ টাকা করে। যা কিনা তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থারও অবনতি ঘটাচ্ছে এবং ব্যবসায়ীদের লাভবান করছেন।
এদিকে, নারায়ণা হেলথের পূর্বাঞ্চলীয় ডিরেক্টর আর ভেঙ্কটেশ জানান, “ সমীক্ষা বলছে যে, বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে প্রতিদিন প্রায় ৪৩৮টি শিশু তামাক সেবন শুরু করেছে। আমরা নারায়ণা হসপিটাল এর তরফে সর্বদা সবসময় উন্নত স্বাস্থ্য পরিষেবা দিলেও বিশ্বাস করি যে রোগ প্রতিরোধ সবসময়ই রোগ সারানোর থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই স্কুল কলেজের ছাত্রদের মধ্যে তামাক ব্যবহার রোধ করতে আমরা সদা সর্বদা সচেষ্ট।” ডাঃ হর্ষ ধর, নারায়ণা সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালের হেড ও নেক সার্জেন এব্যাপারে বললেন যে, “আমার রোগীদের বেশির ভাগেরই মুখের ক্যান্সারের জন্য অপারেশন করতে হয়েছে এবং এর ফলে তারা মানসিকভাবে ভয়ংকর আতঙ্কগ্রস্ত ও আর্থিকভাবে প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। তাদের জীবনের প্রায় ৫০% তারা এই তামাক ব্যবহার এর কারণে হারিয়েছে। তারা এখন তামাক সেবন কেন শুরু করেছিল তা ভেবেই হা–হুতাশ করচ্ছে।
ডাঃ ধর আরও বললেন যে, বর্তমানে প্রতিনিয়ত এই ধূমপানের কারণেই ক্যান্সার নামক মারণ রোগ, দীর্ঘস্থায়ী ব্রঙ্কাইটিস, এমফিসমা, হৃদরোগ, স্ট্রোক ইত্যাদি রোগের ঝুঁকি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আর অপরদিকে, পরোক্ষভাবে শ্বাস প্রশ্বাসের দ্বারা ধূমপানে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার, ফুসফুসের রোগ, হাঁপানি বা শ্বাসকষ্ট ও বাচ্চাদের মধ্যে কানের সংক্রমণের ঝুঁকি পশ্চিমবঙ্গে অধিকতর রূপে দেখা যাচ্ছে। আইডিএ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শাখার সচিব ডাঃ রাজু বিশ্বাস বললেন, “ধূমপান ছাড়াও ধোঁয়া বিহীন তামাকের ব্যবহারও মুখের স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ঝুঁকির। তামাক মুক্ত স্কুল কলেজের ভাবনা শিশু বা প্রাপ্ত বয়স্কদের এবং এমনকি তাদের বাবা-মা এবং শিক্ষকদের মধ্যেও তামাক ব্যবহার প্রতিরোধে সহায়তা করবে বলেই আমি মনে করি।”
কোটপা (সিগারেট এবং অন্যান্য তামাক পণ্য আইন,২০০৩) আইনানুসারে এর বিভিন্ন বিভাগের অধীনে পুলিশ জনস্থানগুলিতে ধূমপান, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিজ্ঞাপন ও তার প্রচার, ১৮ বছরের কম বয়সীদের কাছে বা তাদের দ্বারা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়, স্কুলের ১০০ গজের মধ্যে তামাক জাত দ্রব্য বিক্রয় এবং বিধিবদ্ধ সতর্কতা ছাড়াই তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করলে তার বিরুদ্ধে আইনিব্যবস্থা নিতে পারে। সর্বোপরি তাদের আজকের এই স্বাস্থ্য সম্বন্ধীয় আলোচনায় তাদের এবং সংবাদ মাধ্যমের কথোপকথনে বার বার এটাই উঠে এসেছে যে, এত এ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম, স্বাস্থ্য সচেতনতা মূলক শিবির, ক্যান্সার প্রতিরোধ ও সচেতনতা শিবির, সমাজ সচেতনতা সম্বন্ধীয় শিবির, আন্তর্জাতিক ক্যান্সার দিবস পালন বা অ্যান্টি টোবাকো ডে অথবা আজকের এই নো স্মোকিং ডে মানে ধূমপান নিষিদ্ধ দিবস পালনের দ্বারা সমাজ তথা পশ্চিমবঙ্গকে তামাক বর্জিত করা বোধহয় কখনোই সম্ভব নয়, যদি না সরকার পক্ষ থেকে পরোক্ষভাবে এর বিরোধিতা করে তামাকজাত দ্রব্য তৈরির কারখানাগুলি বন্ধ করে তামাক উৎপাদন থেকে বিরত করা যায় এবং রাজ্যে এই বিষয় কঠোর থেকে কঠোরতম আইন আনয়ন করে সমাজব্যবস্থা ও যুব সমাজকে সেই আইনকে মান্যতা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সচেতনতা মূলক শিবির স্থাপন করা হচ্ছে। যদি আদতে তা সত্যি করা যায়, একমাত্র তবেই আমাদের রাজ্য, বিশ্ব দরবারে যে বাংলা শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপার খ্যাতি অর্জন করেছে তাকে ক্যান্সার নামক মারণ রোগের হাত থেকে অনেকাংশে রক্ষা করা সম্ভব।
খুব ভালো খবর ॥