নিষ্ঠা-কর্মে বাহিত ৩৬ বছর তবু ব্রাত্য হয়ে বিদায় উত্তর ২৪ পরগনা জেলার তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের কর্মী সুনীল দাসের
HnExpress ধৃতরাষ্ট্র দত্ত, বারাসাত ঃ ‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই কেন মনে রাখো তারে। ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে।’ এই কি তার পুরস্কার। নাকি তিরস্কার??
সাধারণ ভাবে ভাল কাজ করতে পারলে পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই কি তার পুরস্কার?? লক্ষমাত্রার চেয়ে ঢের ভালো কাজ করেও ৩৬ বছরের চাকরি জীবনে পদোন্নতি হল মাত্র একবার। ফলে হওয়ার কথা ছিল ক্ষেত্র তথ্য সহায়ক। কিন্তু বিদায় নিলেন কনিষ্ঠ ক্ষেত্র তথ্য সহায়ক হয়েই। একে কি বলা হবে পুরস্কার। নাকি তিরস্কার? অথচ তিনি ছিলেন উত্তর ২৪ পরগনা তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের স্তম্ভ। সব্যসাচীর মত কাজ পাগল এই মানুষটি কাজের মাধ্যমেই হয়ে উঠেছিলেন বারাসাতের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের প্রানভোমরা।বাম-ডান দুই সরকারেরই খামখেয়ালে আতান্তরে থেকেই চাকরি জীবন থেকে অবসর নিলেন তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের নিষ্ঠাবান বঞ্চিত কর্মী সুনীল দাস।
বঞ্চনা আর যন্ত্রনায় বিদ্ধ ছিল তাঁর চাকরি জীবন। সাংবাদিক দরদি সুনীল দাস ১৯৮২ সালে রাজ্য তথ্য সংস্কৃতি দফতরে গ্রুপ ডি পদের কাজে যোগ দেয়। ১৯৮৫ সালে কাজের নিরিখে পদোন্নতি হয়। ওই একবারই। আর কোনওদিন পদোন্নতি হয়নি। অথচ তাঁর সমসাময়িক কর্মীরা অনেকেই আজ অফিসার হয়েছেন। শুধু অফিসারই নয়।পশ্চিমবঙ্গ নাট্য অ্যাকাডেমীর সচিব পদেও আসীন হয়েছেন। কিন্তু সুনীল দাসের চাকরি জীবন রয়ে গেল জীর্ন-ব্রাত্য। তিনি কাজপাগল ছিলেন, এই কি তাঁর অপরাধ?? সেই কারনেই কি তিনি দফতর থেকে তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু পেলেননা। রাত পোহালেই নতুন বছর।আর তার আগেরদিন সুনীল বাবু চাকরি জীবন থেকে অবসর নিলেন। ধরাবাঁধা ছাঁচে ওইদিন দফতর থেকে কোনও বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়নি তাঁকে।হয়তো তাঁর বিদায় সংবর্ধনা পাওয়ার ক্ষেত্রেও হবে ঢিলেমি??
সুনীল দাসের চাকরি জীবনে পদোন্নতি না হলেও দফতরের প্রতিটি কর্মীর সঙ্গে তাঁর মধুর সম্পর্ক ছিল। ওঁর চাকরি জীবনের বিদায় লগ্নে সুহৃদদের ভিড় ছিলনা। হয়তো কাজের বিনিময়ে বেতন পেতেন বলেই কী? কাজের স্বীকৃতি হিসেবে দফতরের কাছে অনেক প্রত্যাশা ছিল তাঁর। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের বারাসাতে ৬ বছর ধরে কাজ করছেন। কাজের প্রতি তাঁর অনবদ্য আন্তরিকতা বরাবরই সকল সাংবাদিক-সংস্কৃতি কর্মীদের মুগ্ধ করেছে। আমাকেও। বছরখানেক আগেই শুনেছিলাম, আমাদের সকলের প্রিয় সুনীল দা ২০১৮- র ৩১ ডিসেম্বর চাকরি থেকে অবসর নেবেন। মনে রেখেছিলাম দিনটি। আলোচনা করলাম বারাসাত প্রেস ক্লাবের সম্পাদক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের সঙ্গে। প্রদীপ্ত দা ব্যস্ত থাকায় আমার প্রস্তাবকে সমর্থন করলেন।
সেই মত ওই দিন একটি রজনীগন্ধার মালা আর গোটা কয়েক রসগোল্লা নিয়ে রওনা হয়েছিলাম বারাসাত তথ্য সংস্কৃতি দফতরে। ভেবেছিলাম, হয়তো এমন সফল কর্মীকে বিদায় লগ্নে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্যে ভিড় উপচে পড়বে। কিন্তু গিয়ে যে দৃশ্য দেখলাম। তাতে আমি ব্যাথিত। সেদিনও তিনি কাজে ডুবে রয়েছেন। নেই কোনও ভিড়। অন্যদিকে বসে শুধু কাজ করছেন আরেক বর্ষীয়ান নিষ্ঠাবান কর্মী সুনীল দাস। আমি যেতেই সুনীল দা তাঁর পুরনো ঢঙেই বসতে বললেন। বসেই জিজ্ঞাসা করলাম, আজ তাঁর চাকরি জীবনের শেষ দিন কিনা??তিনি জানালেন, আজই তাঁর চাকরি জীবনের শেষ দিন। অথচ দফতর শুনশান। নেই বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন?? ফোন করলাম হৃদয়বান তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক প্রসেনজিৎ মন্ডলকে। তিনি জানালেন, ১৫ মিনিটের জন্য বাইরে এসেছেন। ফের ফিরে আসবেন দফতরে। বসে রইলাম। ফিরে এসেই ডেকে নিলেন আমাকে। যাওয়ার সময় আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল দুই সহকর্মী রতন নন্দী ও কল্যান চৌধুরীর। তাঁদের সুনীল দাকে সম্মান জানানোর কথা বলতেই ওরাও গিয়েছিল আমার সঙ্গে। ওদের নিয়েই আধিকারিকের ঘরে ঢুকলাম। সুনীল দাকে সম্মান জানানোর কথা বলতেই তিনি উৎফুল্ল হয়ে আমার প্রস্তাবে রাজী হওয়ার কথা জানালেন। নিজেই তাঁর ঘরে ডেকে নিলেন শ্যামা দা, রঞ্জন দা ও আরেক তরুন কর্মীকে। সুনীল দাকেও ডাকলেন। আমি সুনীল দার গলায় মালা পড়াতেই অবলোকন করলাম, সুনীল দার চোখ ঝাপসা। চোখের কোন চিকচিক করে গড়িয়ে পরলো দু’ফোটা চোখের জল।
এ দৃশ্য দেখে আমার হৃদয়-পিঞ্জর মুচড়ে উঠলো। নিজেকে সংযোত করে সুনীল দার হাতে তুলে দিলাম রসগোল্লার আধুনিক কৌটো। উপস্থিত সকলেই তখন বিহ্বলিত। ওই সময় এত কিছুর পরেও আমাকে যে দৃশ্য অবাক করলো। তা হলো, আধিকারিক প্রসেনজিৎ মন্ডল তাঁর ব্যাগে রাখা বেশ কিছু ব্ক করা রসগোল্লা আর সুনীল দার মেয়ের জন্য চকলেট তুলে দিলেন সুনীল দার হাতে।অনারম্ভর না থাকলেও প্রসেনজিৎ বাবুর ব্যাক্তিগত প্রচেষ্টা আমাকে মুগ্ধ করলো। এর পরে অনেক কথা হল। তবে যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষিত করলো তা হলো, ‘সুনীল দাকে যদি ঠিক ঠিক পদোন্নতি দেওয়া হত, তাহলে সুনীল দা আমার থেকেও এখন উচ্চ পদে আসীন থাকতেন’।
সুনীল দাস ছিন্নমূল উদবাস্তু হিসেবে এপারে এসে জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বাবা প্রয়াত হরিপদ দাস শ্রমিকের কাজ করতেন। ৪ ভাই ২ বোনের সংসারে তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যেই বেড়ে ওঠেন। সুনীল দা। নিজের বিষয়ে মুখ খুলতে না চাইলেও তাঁর ফুপিয়ে না ওঠা চোখের জল অনেক বঞ্চনা-যন্ত্রনার কথা বলে দেয়।সুনীল দার চোখের জল তখন মনে হয় আরও বলছিলো,’আমি চিরতরে দুরে চলে যাব,তবু আমারে দেব না ভুলিতে।’ আমার এ লেখা কাউকে আঘাত করার জন্য নয়, এ লেখা আমার সম্পূর্ণ ব্যাক্তিগত আবেগ-অনুভূতি।