উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত তথা দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার নয়া বাজার এর বিখ্যাত দই ও মাছের ইতিকথা
HnExpress পল মৈত্র, দক্ষিন দিনাজপুর ঃ উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত তথা দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার মানুষেরা কিন্তু ঐতিহাসিক সম্পদের ওপরে বাস করছেন, কারণ এই শহরের মাটি খুঁড়লেই মিলত মৌর্য আমলের নানান সরঞ্জাম। কখনও মিলেছে মোগল আমলের জিনিসপত্র। আবার কুষাণ যুগ, গুপ্ত সাম্রাজ্য, পাল, সেন আমলের সামগ্রীও কিছু কম মেলেনি। জায়গার নাম বাণগড়।
প্রবীণ বাসিন্দারা জানান, দিনাজপুরের কাছারি থেকে পুনর্ভবা নদীর তীরের ওই সমৃদ্ধ জায়গার পত্তন করেছিলেন গঙ্গারাম চৌধুরী। ১৭৫১ সালে বর্গির হামলা ও অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে সেই সময় মুর্শিদাবাদের নবাব আলিবর্দি খাঁর সহায়তা চান তিনি। তাই অনেকেই মনে করেন যে, সম্ভবত গঙ্গারাম চৌধুরীর নামেই নামকরণ এই গঙ্গারামপুরের। তবে সেই পুনর্ভবা আজও আছে।
যদিও আজ, পুনর্ভবার উপরে কংক্রিটের তৈরি বিশাল সেতু। মসৃণ চওড়া পাকা রাস্তা। মালদহ থেকে জেলা সদর বালুরঘাটের মধ্যে সহজ ও দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা। ১৯৫০ সালের আগে তা কল্পনায় আনা যেত না।
এদিকে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক পার্থ মৈত্র বলেন, “বালুরঘাট থেকে সরু ও খন্দে ভরা রাস্তা ধরে গুটি কয়েক বাস এসে পৌঁছত। গঙ্গারামপুরের পুনর্ভবার তীরে নৌকায় পার হয়ে ওপার থেকে ফের বাস ধরতে হত। সেখান থেকে এক দিকে মালদহ ও অন্য দিকে উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জের ন্যারো গেজ রেললাইন ধরতে হত। ”গঙ্গারামপুর শহরবাসীর কাছে সে সবই এখন অতীত।
শহরের চৌপথি থেকে পশ্চিম দিকে চওড়া রাস্তার ধারে বাস স্টপের বেহাল অবস্থা কিছুটা হলেও পাল্টেছে। ঝাঁ চকচকে নতুন একটি বাস টার্মিনাস চালু হয়েছে। তবে পুর পরিষেবা নিয়ে অভিযোগ নেই বললেই চলে, জল, নিকাশি সব ব্যবস্থাই এখন মোটামুটি ভালো। পুরসভার পক্ষ থেকে প্রতিটি পরিষেবার মান উন্নয়নের জন্য একাধিক প্রকল্পের কাজ চলছে।
অন্যদিকে গঙ্গারামপুর কিন্তু গোটা উত্তরবঙ্গের কাছেই দু’টি কারণে এখনও বেশ বিখ্যাত। মিষ্টি দই আর মাছ। গঙ্গারামপুরের নয়াবাজারে তৈরি মিষ্টি দইয়ের কদর উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চর্চিত। অথচ সুষ্ঠু বিপণনের অভাবে সেই দই ঠিকঠাক বাজারজাত হয়নি। কারিগররা পাননি সরকারি আনুকূল্য। সরকারের পক্ষ থেকে পরামর্শ পাননি তাঁরা। একটা সময়ে কয়েকশো পরিবার দই তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
এখন সাকুল্যে ৪০ থেকে ৫০ টি পরিবার দই তৈরি করে। এক দই ব্যবসায়ী পরিমল ঘোষ বলেন “গত ৬০ বছর ধরে এই পেশায় সঙ্গে আমরা যুক্ত। আগে গোটা উত্তরবাংলায় যেত। এখন দই বিক্রির বাজার বলতে মূলত গঙ্গারামপুর শহরই ভরসা। দোকানগুলি থেকে দৈনিক তিন থেকে চার কুইন্ট্যাল দই বিক্রি হয়।” কয়েকজন ব্যবসায়ী নিজের উদ্যোগে শিলিগুড়িগামী রাতের বেসরকারি বাসের মাথায় তুলে দেন দইয়ের বাক্স।
বড় জোর ৫ কুইন্ট্যাল দই। শিলিগুড়ি থেকে জলপাইগুড়ির কিছু দোকানে গঙ্গারামপুরের দই বিক্রি হয়। অথচ কলকাতা সহ দক্ষিণবঙ্গে গঙ্গারামপুরের মিষ্টি দইয়ের বাজার ধরতে পারলে অর্থনীতি যে শক্তিশালী হত, তা নেতা-কর্তারা সকলে মানেন।বাম আমলে দীর্ঘদিন ক্ষুদ্র ও কুটীর শিল্পমন্ত্রী ছিলেন গঙ্গারামপুরের বাসিন্দা সিপিএম নেতা নারায়ণ বিশ্বাস।
তাঁর বিরুদ্ধে মিষ্টির কারিগরদের একাংশের অভিযোগ, বহুবার বলা সত্ত্বেও তিনি দই ব্যবসায়ীর পাশে দাঁড়াননি। সরকারি সাহায্য না পেলেও হাল ছাড়েননি ব্যবসায়ীরা। তাঁরা নয়াবাজারে দুগ্ধ ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি গড়ে দই তৈরি করে চলেছেন। মাছ চাষ ও ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত কয়েকশো মত্স্যজীবীও বর্তমানে নানা সমস্যায় ধুঁকছেন।
তিন দশক আগে গঙ্গারামপুরে অন্তত ৩ হাজার ছোট-বড় পুকুর ছিল। কালদিঘি, ধলদিঘি ও প্রাণসাগর দিঘির মতো তিনটি বড় জলাশয় এবং পুনর্ভবা নদী ও তার খাঁড়ি, অজস্র খালবিলে উপচে পড়ত মাছ। মাছের দৌলতে উত্তরবঙ্গের মধ্যে বৃহত্ মত্স্যজীবী সমবায় সমিতি গঙ্গারামপুরেই গড়ে ওঠে। কিন্তু বহু জলাশয়, পুকুর ভরাট করে অট্টালিকা, বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় মাছেরা উধাও হয়েছে।
পুনর্ভবাতেও আর সেরকম জল নেই। গ্রীষ্মের দাবদাহে বালিতে কচিকাঁচারা ফুটবল খেলে। গরিব মত্স্যজীবীদের অনেকে পেশা হারিয়ে কেউ শহরে ভ্যান রিকশা বা টোটো চালাচ্ছেন। আবার কাজের খোঁজে কেউ ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন। মত্স্যজীবী সমবায় সমিতির সদস্য সংখ্যা কমেছে। শহরের ফুটবল মাঠ লাগোয়া বড় মাছের বাজারে দাঁড়িয়ে মত্স্য ব্যবসায়ী মনোতোষ হালদারেরা বলেন, “উত্তরবঙ্গে এখনও আমাদের এই সমিতি সদস্য সংখ্যার বিচারে এক নম্বরে।
কিন্তু মাছের জোগানে পিছিয়ে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে পুকুর দিঘিতে মাছের চাষ করছি।
সরকারি তরফে অর্থসাহায্য, পরামর্শ ঠিক মতো মিললে হয়েতো আরও অনেক দূর এগোনো যেত। তাই বিস্তর সম্ভাবনা থাকলেও আরও অনেক কিছুতেই এগোতে পারেনি গঙ্গারামপুর ও তার এলাকাবাসী।